সাঁতরে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এক শিলাখণ্ডের উপর ধ্যানমগ্ন স্বামীজি, কন্যাকুমারীতে জীবনের কিছুটা সময়

সেইবার পুজোয় আমরা কয়েকটা পরিবার মিলে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমাদের বারাসাতের  ট্যুর এজেন্সি ‘দেবী স্পেশাল’-এর সাথে। ষষ্ঠীর দিন রাত্রিবেলায় হাওড়া থেকে করমন্ডল এক্সপ্রেসে উঠি, আর পরের দিন সন্ধ্যায় চেন্নাই সেন্ট্রালে পৌঁছাই, সেখান থেকে তারও পরের দিন এর্ণাকুলামে নেমেছিলাম। তারপর একে একে কোচি, কোভালাম, মুন্নার হয়ে অবশেষে কন্যাকুমারীকার পথে পা বাড়িয়েছিলাম। সেই সময়ের স্মৃতিকথাই আজ লিপিবদ্ধ করছি।


আজ আমি কন্যাকুমারীকায় এসে পৌছালাম। সারাদিনের ধকলের পরও মনের ভালও লাগা শারীরিক ক্লান্তিকে মুছে দিয়েছে। মনের ভিতর থেকে হঠাৎ কোথাও যেন একটা অব্যক্ত ভালোলাগা টের পাচ্ছি| আসলে দক্ষিণ ভারত ঘুরতে বেরিয়ে জায়গাগুলো মনের গভীরে কিছু একটা ভাললাগা করে নিয়েছে বুঝতে পারছি। ‘কন্যাকুমারী’ বলতেই মনে পড়ে স্বামী বিবেকানন্দ| কন্যাকুমারী নামক দেবী, যাঁর কথা পুরাণে কথিত আছে, বিবাহযোগ্যা সেই দেবী মালা হাতে নিয়েই রয়েই গিয়েছেন দেবতাদের বুদ্ধি-চতুরতার কাছে হার মেনে। এই ঘটনা আর আমাদের জীবনের ঘটনা যেন কোথাও মিলে যায়| জানতে ইচ্ছে করে, বাস্তবের টানাপোড়েনে  জীবনের সহযাত্রীর আগমনের জন্য মেয়েদের কি আজও এইভাবেই অপেক্ষা করতে হয়?


ভারতের দক্ষিণভাগের শেষ ভূমিখণ্ড কন্যাকুমারীতে এসে মনেই হচ্ছে না, যে কলকাতার বাইরে এসেছি। চারিদিকে যেন বাঙালিয়ানার সুবাস। কন্যাকুমারীর জলভাগ, সমুদ্র, ঢ়েউ দেখবার মতো। ঢেউ-এর পর ঢেউ| চোখ ফেরানো যায় না| হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে আমি। কী হাওয়া! আর তেমনি সাগরের ঢেউ। বাতাস আর জলের স্রোত যেন তালসঙ্গত করে চলেছে অনবরত। দূরে আরও অনেক দূরে দেখা যায় এক টুকরো আলোকবিন্দুর ঝলকানি। পরে জানলাম ওই জায়গাটাই হলো ‘বিবেকানন্দ রক’।



ইতিহাস কথা বলছে কন্যাকুমারীতে। স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে তৎকালীন কন্যাকুমারী নামক এক অখ্যাত গ্রামে এসে উঠেছেন, সাঁতরে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এক শিলাখণ্ডের  উপর ধ্যানমগ্ন স্বামীজি। অনুভব করছেন ভারতবাসীর দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র‌, মর্মবেদনা, হতাশা। হয়ে উঠছেন ভারতবর্ষের যুগপুরুষ, ভাবীকালের মহানায়ক। গুরু রামকৃষ্ণের আদেশ লাভ করছেন শিলাখণ্ডের উপর বসেই  আর মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছেন আমেরিকাযাত্রার জন্যে। তারপর তো একের পর এক দৈব যোগাযোগ। মা সারদা অনুমতি দিচ্ছেন, খেতড়ীর রাজা অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করছেন।

স্বামীজি ভারতের শেষ ভুমিখণ্ড ত্যাগ করছেন, যাত্রা করছেন পরদেশে। আর তারপর তো সবটাই ইতিহাস।এখন সেই খানে হয়েছে মন্দির,উপাসনাগৃহ। শিলাখণ্ডের উপর আছড়ে পড়ছে ঢেউ। এই  সমুদ্র, শিলাখণ্ড  সবই অতীতকে মনে করায়। এই সমুদ্রে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর আর বঙ্গোপসাগরের জলরাশি মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। আর এই জলরাশির সম্মিলিত গর্জন যেন ভারতভুমির বিভিন্ন প্রান্তের কলরবকেই মনে করাচ্ছে। সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটাই কথা বারংবার মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা কত বড়। এই নিখিল বিশ্বমাঝে মানুষ তো অতি ক্ষুদ্র এক জীব। বিশাল এই পৃথিবীর বিচিত্র কর্মশালা। এখানে চারিদিকে শুধুই জল আর জল। এই নিখিল বিশ্বে মানুষের জীবনই বা কতদিনের।
মানুষের দুঃখ, কষ্টই সবই তো একদিন এই সাগরের গর্ভে তলিয়ে যাবে। জগতের এ সবই তো নশ্বর।


অদ্ভুত ভালো লাগলো কন্যাকুমারীর সকালবেলা। গোটা আকাশটা যেন নীল রঙের তুলি দিয়ে বুলিয়ে দিয়েছে, লাল সিদুঁরের টিপ আকাশটাকে আরও মোহময়ী করে তুলছে। বাতাসের সাথে সাথে নতুন সুরের মূর্চ্ছনা শোনা যাচ্ছে, বাঁ দিকের চার্চ থেকে মন্ত্র, আশেপাশের কোনও মসজিদ থেকে আরবী কথামালার সুর, আবার কোনোখান থেকে স্থানীয় সুরের ধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রকৃতি তার রূপ, রস, গন্ধ ঢ়েলে সাজিয়ে দিয়েছে এই সকালবেলাকে। সুরের সাথে সুরে মিশে নতুন সুরের স্বরলিপি লেখা হয়ে চলেছে। শুনেছিলাম,দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত এক স্বতন্ত্র ঘরানা, এই সঙ্গীতে ভারতের নিজস্ব আদিসুরধারা আজও অক্ষুন্ন রয়েছে। এই ভাষা আমি বুঝি না, কিন্তু এই সঙ্গীতের প্রতিটি স্বরক্ষেপণ আমার স্নায়ুতন্ত্রে, আমার মনোজগতে কী এক অদ্ভুত আনন্দের সৃষ্টি করছে, তা নিজেও ঠিক বোঝাতে পারছি না। সকাল দেখেছি আগেও। ভোর রোজই হয়। কিন্তু এই সকাল অন্য সকালের থেকে আলাদা বলতেই হচ্ছে।


ভোরের আকাশে চারিদিকে আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। আকাশটা যেন নীল ওড়নায় ঢাকা পড়তে চাইছে। ভোরের ঠান্ডা বাতাস, ভোরের স্তোত্র বা প্রার্থণার সুর নীল রঙের সমুদ্রে সাদা সাদা ঢেউ যেন সঙ্গীতলহরী রচনা করে চলেছে।
স্পষ্ট দৃশ্যমান হচ্ছে বিবেকানন্দ রক। দূরে সমুদ্রের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই যেন চেয়ে আছে স্থানীয় তামিল কবির স্ট্যাচু। সমুদ্রতটে বাঁধা আছে অনেকগুলো নৌকা, হয়তো তারা জীবনের সমুদ্রে চলা শুরু করবে এখুনি। এইসব দেখতে দেখতে মন কোথায় যেন চলে যেতে চাইছে আর অনেক কথাই ভাবাচ্ছে।


আসলে জীবনের সব কথা তো বলা হয়ে ওঠে না, অনেক কথাই না বলা রয়ে যায়। মানুষ তার সব কথা বলার মানুষ সঠিক সময়ে খুঁজে পেতে চায়। কেউ পায়, কেউ বা পায় না,আর কেউ বা অনেকটাই পরে গিয়ে পায়। জীবন মানুষকে শিখিয়ে চলে মৃত্যুর প্রাক্ মুহূর্ত পর্যন্ত। নানা শিক্ষালাভ করতে করতেই মানুষের জীবনতরী এগিয়ে চলে।

এর মধ্যেই কত মানুষের সাথে দেখা হয়, আলাপ-পরিচয় হয়,আবার কালের নিষ্ঠুর নিয়মে কোনো একদিন তাঁরাও আমাদের ছেড়ে চলে যান। সমগ্র জীবনে অনেক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয় আমাদের। জীবনে না পাওয়ার দুঃখ, ভালবাসার মানুষগুলো হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ,নানা অস্থিরতা, অব্যক্ত কষ্ট, মনখারাপ— এসবের মধ্যে থেকেই জীবন থেকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, মনে হয় জীবন আবার ছোটোবেলা থেকেই শুরু করি।

জীবনের অনেক কাজই তো বাকি রয়ে যায়, অনেক কাজ এ জীবনে আর হয়তো করেই ওঠা হয় না; অনেক প্রত্যাশা, অনেক ইচ্ছে মনে মনেই থেকে যায়, এ সবের মধ্যেই অন্য সকলের মতো পথ চলতে হয়,কিন্তু অস্থিরতা মন থেকে কিছুতেই যেতে চায় না। জীবনের ঢেউ আসে আর যায়, আর সমুদ্রের পারে রেখে যায় তার চিহ্ন। বিবেকানন্দের আদর্শই আবার নতুন করে ভাবতে শেখায় জীবনের এই চলার পথে, তাঁর কথাতেই শত দুঃখের মধ্যেও মনটা আবার ভাবতে শুরু করে গতিই জীবন, স্থবিরতাই মৃত্যু। তাই আমাদের সবাইকে চলতেই হয়। এ চলার কোনো থামা নেই।