ধর্ম ও প্রকৃতির সমৃদ্ধিতে কামাখ্যা দর্শন

রুনা চৌধুরি (দাস)

পুণ্যতীর্থ ভারতবর্ষে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থানগুলি প্রাকৃতিক শোভায় অতি মনোরম। এইসব তীর্থে গেলে মনপ্রাণ যেমন জুড়িয়ে যায়। ভারতের বুকে যতগুলি মহাতীর্থস্থান আছে। সতীপীঠ কামাখ্যা হলো তার মধ্যে মহাপুণ্যস্থান। এটি আসামের বৈচিত্র্যময় কামরূপ রাজ্য অবস্থিত। মহাপীঠ দেখতে হাওড়া স্টেশন থেকে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে দুপুর ৩.৪৫-এর ট্রেনে গুয়াহাটি অভিমুখে রওনা হলাম। ফরাক্কার বাঁধ, নিউজলপাইগুড়ি, গোয়ালপাড়া, কামাখ্যা স্টেশন অতিক্রম করে সকাল সাড়ে ন’টায় গুয়াহাটি স্টেশনে নামলাম। এর প্রাচীন নাম হল প্রাগজ্যোতিষপুর। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি বুক করে তিন মাইল দূরে কামাখ্যা পৌঁছে গেলাম মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে।

গুয়াহাটি আসামের প্রসিদ্ধ মহানগর। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত। আসামের অন্যতম বাণিজ্যিক স্থান। কামাখ্যা পাহাড় বেষ্টিত, পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি, রাস্তার দুধারে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির, বিগ্রহ, শিল্পকলার নিদর্শন দেখতে দেখতে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে কামাখ্যা মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। কামাখ্যা পবর্তের নাম নীল পর্বত। এখানেই কামাখ্যা দেবী অধিষ্ঠিত। মন্দিরহ সংলগ্ন ‘রামনিবাস’ লজে উঠলাম। কালিকা পুরাণাদি থেকে জানা যায় যে, ভারতের বুকে একান্নটি মহাপীঠ এবং ছাব্বিশটি উপমহাপীঠ অবস্থিত। বিষ্ণুচক্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে সতীদেহ যে যে স্থানে পতিত হয়েছে, সেই সকল স্থানে মহাপীঠ স্থাপিত হয়েছে। এটি দেবীর মহামুদ্রা বা যোনিপীঠ। এখানে দেবী কামাখ্যারূপে বিরাজিতা ও ভৈরব উমানন্দ নামে বিরাজিতা। সবুজ, শ্যামল বৃক্ষবেষ্টিত পর্বত মন্দিরের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে স্বভাবতই আকৃষ্ট করে।

সেদিন সন্ধ্যবেলায় বাইরে থেকেই মন্দির দর্শন করলাম এবং আরতি দেখলাম। পরেরদিন ভোর চারটেয় স্নানাদি সেরে মেয়েকে নিয়ে অঞ্জলি দেবার উদ্দেশ্যে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ালাম। ভোরেই বিশাল দর্শনার্থীর লাইন পড়ে গেছে। সকাল ৮টায় প্রধান মন্দিরের দ্বার খুলল। প্রথমে গণেশ মূর্তির দর্শন করে কামাখ্যা মায়ের দর্শন করতে হয়। পাশেই শীতলা মায়ের মন্দির। তারা মায়ের দর্শন করে কামাখ্যা মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরের দ্বার উদঘাটন হতেই ভক্তবৃন্দ যে যার পুরোহিতের সাহায্যে ভক্তি সহকারে পুজোয় নিমগ্ন হয়ে গেল। আমরাও পূর্ব নির্ধারিত পূজারী চিন্ময় শর্মার নির্দেশে ভালোভাবে মাকে দর্শন করে মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজো দিতে পেরেছি। রুপোর সিংহাসনের উপর মায়ের মূর্তি বিরাজমান। মা ফুলের অজস্র  মালায় সুশোভিত। এরপর দশটি সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ নীচে নেমে অন্ধকার গুহার মধ্যে মায়ের মহামুদ্রাপীঠ ফুল, মালা, রক্তবস্ত্রে আবৃত্ত তার পাশ দিয়ে সূক্ষ্ণ জরে ধারা বয়ে চলেছে। যোনিপীঠের ওপরের অংশ  সোনার মোড়কে আবৃত। ওই জল স্পর্শ করে মার পায়ে প্রণাম করে পূজার্চনার পরম সৌভাগ্য প্রাপ্ত করলাম। সেই সময়কার রাজা বিশ্বসিংহ দেবীর নির্দেশে প্রতিটি ইটের সঙ্গে এক রতি করে সোনা দিয়ে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তার আগেও প্রবল পরাক্রান্ত রাজা ধর্মপাল কান্যকুব্জ থেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের এনে তাঁর রাজ্যে স্থান দেন। এরাই হলেন কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান ও আদি পূজারী। বংশপরম্পরায় তাঁরা মাতৃপূজায় নিযুক্ত হন। তাঁরা প্রচণ্ড ধর্মপ্রাণ এবং যাত্রীদের সুবিধা, অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। কামরূপ দেবীক্ষেত্র। এর অনুরূপ স্থান আর কোথাও নেই। দেবী অন্যত্র বিরল হলেও কামরূপে তিনি ঘরে ঘরে বিরাজিতা এবং পূজিতা হন। কামাখ্যা দেবীর নিত্যপূজার অঙ্গরূপে রোজ একটি ছাগ বলিদান করা হয়। অনেক সময় মোষ, পায়রাও বলি দেওয়া হয়। সেইসব ভোগের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হয়। কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের উত্তরদিকে দেবীর ক্রীড়া পুষ্করিণী আছে, এর নাম সৌভাগ্যকুণ্ড। এর তীরে গণেশ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। প্রতি সন্ধ্যায় আরতি হয় তখন প্রসাদ বিতরণ হয়। মন্দিরের চারপাশে হনুমান, বাঁদরদের উৎপাত থাকলেও এরা মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। মন্দিরের দু’পাশে হরেকরকম সামগ্রীর দোকান যেন ঢেলে হাট বসেছে।

এরপর ১৩৫ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ভুবনেশ্বরী মন্দির দর্শনের অভিপ্রায়ে আমি মেয়েকে নিয়ে পদব্রজেই পাহাড় পরিক্রমা করলাম। ব্রহ্মপুত্রের মনোরম শোভা, নদের মাঝে আয়ারল্যান্ড, দেবদারু, টিক, শাল, মহুয়া, পাইনের ঘন ঝোপে ঘেরা পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য পদব্রজের ক্লান্তিকে নিমেষে উড়িয়ে দিয়ে মনে আরও দ্বিগুণ উৎসাহ, উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিল। চূড়ায় ওঠার পর এক স্বর্গীয় পরিবেশ অনুভূত হল। তার মাঝেই ভৈরবী মন্দির, ছিন্নমস্তার মন্দির, ধুমাবতী, শিবের পঞ্চপীঠ এবং সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার সময় বগলাদেবীর মন্দির দর্শন করলাম। আষাঢ় মাসে অম্বুবচীর সময় অগণিত যাত্রী আসেন দেবীতীর্থ কামাখ্যা মহাপীঠ দর্শনে, তখন বিরাট মেলা বসে। এখানে কুমারী পুজোও প্রসিদ্ধ।

কামাখ্যা দর্শনের পর পরের দিন ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে সিটি বাসে চড়ে চার ঘণ্টা জার্নির পর শিলং পাড়ি দিলাম। আসাম খণ্ডিত হয়ে যে মেঘালয় রাজ্য হয়েছে তার রাজধানীর নাম শিলং। শিলং পিক নামে চূড়াটির উচ্চতা ৬৫৪০ ফুট। শিলং/ বিমানবন্দরও আছে, যার নাম উমরাও বিমানবন্দর। মেঘালয় বনসম্পদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই স্থানে সেভেন সিস্টারস ফলস, এ্যালিফান্টা ফলস বিখ্যাত। শিলং শীতপ্রধান ও স্বাস্থ্যকর জায়গা। কাশ্মীরে ভূস্বর্গ হলেও শিলংকেও ভারতের সুইজারল্যান্ড বলা হত। শিলংয়ে হোটেল ‘সিরিনে’ ছিলাম। এখানে ন্যাসপতি, আলু, কমলালেবু, কপি, মুলো, শাকসবজির বিপুল চাষ হয়। এছাড়া ঘনঘোর চায়ের চাষ ভারত ছাড়া বিশ্বদরবারেও দার্জিলিং ও আসামের চা জনসমাদৃত। টি-গার্ডেনগুলো সহজেই দৃষ্টিনন্দন হয়ে পড়ে। এখানকার জলপ্রপাতগুলি থেকে হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি উৎপন্ন করে চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিলংয়ের মেয়েরা বেশির ভাগই মেখলা, লুঙ্গি, খাসিয়াদের অনুরূপ ড্রেস পরে। পান ও সুপারী এখানে সকলের মুখোরচক সঙ্গী। পৃথিবী বিখ্যাত সেই বৃষ্টিপাতের জায়গা, অথচ দুর্ভাগ্যবশতঃ সে আশা জল হয়ে গেল, যখন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটারও আভাস দেখলাম না। কিছদূর উঠেই মেসমারাই কেভস দেখলাম। চেরাপুঞ্জির খুবলাইতে এই গুহা। 70 টাকার টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। পোকামাকড়, সাপ, বিছে থেকে সতর্কতার নির্দেশ বোর্ডে দেওয়া আছে। মাথা নীচু করে পাহাড় কাটা গুহার মধ্য দিয়ে এগুতে লাগলাম। কাটা গুহার মধ্য দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে. এবড়ো খেবড়ো আকারে প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি গুহাটি। ভয়ানক অনুভূতির মধ্যেই গুহার অপর প্রান্ত দিয়ে মাথা নীচু করে বেরেতে হয়। এখাকার বিশপ ফলস, এ্যালিফান্টা ফলস, মেঘালয়ের আকাশভরা মেঘপুঞ্জের জমাটি ফ্রেম, লেকের জলে হাঁসেদের জলক্রীড়া, বকেদের মাছ ধরার কৌশল সে এক মজার অনুভূতি নিয়ে শিলং ফিরলাম। শিলংয়ে পিরে ১৮ গর্তের গলফ কোর্স দেখলাম। আলোআঁধারি— শিলং শহরকে দেখে আসার পথে ওয়াংখারে প্রজাপতি মিউজিয়ামে দেখলাম কাচের বাক্সবন্দি হাজার হাজার রং-বেরংয়ের প্রজাপতি। যা ভারতের অন্য কোনও শহরে দেখা যায় না। গুয়াহাটি  ফেরার পথে মাওসাই গুহার ভিতরে চুনাপাথরের চুয়ানো জলের সৃষ্টিস্বরূপ নানান মূর্তি, ১৭৫ খানা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়া জলপ্রপাত এালিফান্টার অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির সৃষ্টি মনকে ভীষণ উথালপাতাল করে দিয়েছিল। গুয়াহাটির ‘সুমিলজে’ তৈরি হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। নদের তীরে উপত্যকার উপর আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে তৈরি গুয়াহাটি মহানগর যেন প্রকৃতির কোলে সভ্যতার দৃষ্টান্তস্বরূপ। গুয়াহাটিতে বালাজির অপূর্ব মন্দির দর্শন করলাম, যা দক্ষিণ ভারতের তিরুপতি মন্দিরের অনুরূপ। ভিতরে বালাজির মার্বেলে মূর্তি স্বর্ণালঙ্কারে বিভূষিত। ঘিয়ে ভাজা সাবুর পায়েস প্রসাদ খেলাম। এরপর চললাম অটো করে বিশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে। গৌহাটি থেকে 7 মাইল দূরে এই আশ্রম। পাহাড় ঘেরা নির্জন জায়গা, উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সোঁ-সোঁ গর্জনে জলপ্রপাত বয়ে চলেছে। তার নাম বশিষ্ঠ গঙ্গা। একে ত্রিধারা সঙ্গমও বলে। বশিষ্ঠ দেবের মন্দির থাকলেও তিনি নিরাকার, শুধ ঋষির পদচিহ্ন বিদ্যমান। যার পাশ সর্বদা অন্ধকারের মাঝে প্রদীপ জ্বলে। বশিষ্ঠ মুনির বিশাল এক মূর্তি প্রবেশদ্বারে বিরাজমান। আমি, মেয়েকে নিয়ে ওই গঙ্গায় স্নান করলাম। পাহাড়ি গঙ্গায় আবালবৃদ্ধবনিতা ভয় ডরকে উপেক্ষা করেই জেলে ঝাঁপিয়ে স্নানের মজা উপভোগ করছে, যদিও জলের গভীরতা কোমড় অবধি কিন্তু খরস্রোতা নদী। শান্তি জল সংগ্রহ করলাম। ফেরার পথে শিব, পার্বতী, হনুমানজির মূর্তি দর্শন করলাম। রাস্তার পাশে এক শ্মশান চোখে পড়ল। মেইন রাস্তা থেকে ট্রেকার চড়ে কলাক্ষেত্র দর্শনে গেলাম। এন্ট্রি ফিস ২০ টাকা মাথাপিছু। ক্যামেরার জন্য ১০ টাকা আলাদা চার্জ। এটা এখানকার বিখ্যাত আর্ট সেন্টার। ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বিখ্যাত শিল্পীদের অনুষ্ঠান হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দিল্লির লালকেল্লার মতো লাইট এন্ড সাউন্ডের ‘শো’ দেখানো হয়। ভিতরে গিয়ে লস হাউস দেখলাম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিশেষত আসামের অধিবাসীদের বিভিন্ন কালচারের উপর তৈরি বিশাল নিখুঁত পুতুলগুলি সুন্দর বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে কাচের বাক্সে বন্দি হয়ে ট্যুরিস্টদের আহ্বান জানাতে যেন ব্যস্ত।

কালীপুজার দিনটি এর মধ্যেই পড়েছিল, হোটেলের ব্যালকনি থেকেই পুরো শহরটিকে আলোর বন্যায় ঝলমলিয়ে আতসবাজি, শব্দবাজির ফোয়ারায় মাতোয়ারা হতে দেখলাম। সময়ের অভাবে ফ্যান্সিবাজার ঘোরা হল না। নাইবা লঞ্চে করে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ভেসে বেড়াতে পারলাম।

পরেরদিন গুয়াহাটি স্টেশন থেকে আবার চললাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। সরাইঘাট এক্সপ্রেস নির্বিঘ্নে আমাদের যথাসময়ে হাওড়ায় পৌঁছে দিল। ভোর ৬টায় আবার সেই কর্মচঞ্চল কলকাতায়।