রিয়াংখোলার জলসাঘরে

নন্দিতা মিত্র
তাকদা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজডি়ত মংপু দেখে চলেছি সিটংয়ের দিকে৷ এক জায়গায় এসে ড্রাইভার নিমা ভাইয়া গাডি় দাঁড় করিয়ে দিলেন৷ সামনে একটি ব্রিজ আর তার নিচ দিয়ে কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে ছোট্ট পাহাডি় নদী৷ নদীর নীল, আকাশের নীল, তার পাশে দু’চোখ জুড়ানো সবুজ পাহাড় দেখে ভীষণ ভালো লাগল জায়গাটা৷ মনে হল প্রিয়জনের সঙ্গে অজ্ঞাতবাসের সেরা ঠিকানা এটা৷ জায়গার নাম যোগীঘাট৷ পাহাডে়র চিরন্তন আলো-ছায়া নিয়েই এই জায়গা৷ দুপুরে তখন রুপোলি রোদের ঝিলিক দিচ্ছে স্বচ্ছ জলের বুকে৷ পাশাপাশি দুটো সেতু৷ কাঠ আর বাঁশের মাধ্যমে নির্মিত সেতুটি প্রাচীনতার সাক্ষ্যবহন করে৷ পায়ে চলার উপযোগী এই ব্রিজ বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘বিপদজ্জনক‘ এই সতর্কবার্তা দিয়ে৷
অন্যদিকে তৈরি হয়েছে ধাতব সেতু৷ তথ্যানুসারে ২০১৫ সালের ১৮ই এপ্রিল বিমল গুরুঙের তত্ত্বাবধানে যোগগুরু হিসেবে পরিচিত বাবা রামদেব এই সেতুর উদ্বোধন করেন৷ পূর্বে এই জায়গার নাম ছিল ‘যোগীঘাট রিয়াংতার‘৷ বর্তমানে সেই নাম পরিবর্তিত হয়ে যোগীঘাট হয়েছে৷ একদিকে কার্শিয়াং অন্যদিকে মংপু– এই দুই পাহাডে়র সংযোগকারী হিসেবে কাজ করছে এই সেতু৷ যানবাহন পারাপারের কারণে নদীর ওপরের সেতু সারাদিনই ধাতব শব্দে মুখর৷ সেতুতে হেঁটে চলাচল করার রোমাঞ্চ নিতে বার বার এদিক-ওদিক যাই, ছবি তুলে রাখি৷ সেতুর দুপাশেই বৌদ্ধমন্ত্র সম্বলিত রংবেরঙের লুঙদার হাওয়ায় উড়তে থাকে৷ এখানে থাকার জন্য সেভাবে কোন জায়গা নেই৷ এখনো অনাঘ্রাতা হিসেবে পরিচিতি থাকলেও হয়তো আর কয়েক বছর পরে এসে দেখব এই গ্রামও তার সরলতা হারিয়ে আর পাঁচটা পাহাডি় গ্রামের মতোই ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে৷ তখন হয়তো দেখব এখানেও মুড়ি-মুড়কির মত হোম স্টে গজিয়ে ওঠে নাগরিক সভ্যতা নদীর সারল্য নষ্ট করে একে কর্পোরেট রূপ দিয়েছে!
মাত্র সাডে় তিন হাজার ফুটের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে ঠান্ডা বা গরম কোনটারই তীব্রতা নেই৷ নদীপাডে়র দুই পৃথক জনপদ দুটি কারণে বিখ্যাত৷ একদিকে সিটং ‘কমলালেবুর গ্রাম‘ হিসেবে পর্যটক মহলে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে৷ আরেকদিকে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজডি়ত মংপু চিরকালই বাঙালির প্রিয় শৈল শহর৷ এই জায়গা আসলে সিটং ২ খাসমহলের নিম্নবর্তী অংশ৷ পাহাড়-নদী-উপত্যকা ঘেরা জায়গাটি ছোট হলেও নিসর্গের বিস্তৃত ক্যানভাসে নানা রং লাগিয়ে সে কিন্ত্ত সৌন্দর্যে কোন অংশে কম নয়৷ ছোট্ট রিয়াং নদী কিছুটা হেঁটে হাঁপিয়ে ওঠে৷ তাই একটা বড় নদীর দেখা পেতেই তার হাত ধরে একসঙ্গে ছুটে চলে৷ আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে সে৷ তার কাছে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে দমন করতে না পেরে নেমে পডি়৷ পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেয় শীতল জল৷ শরীরের সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায়৷ পাথরের উপর নিশ্চিন্তে বসে পডি়৷ নরম রোদে কী মিষ্টি দেখাচ্ছে তাকে৷ ছটফটে কিশোরীর মত আদুরে আবেশে সে তার গল্প শোনাতে শুরু করে৷ শরতের প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে ক্রমশ মেলে ধরতে থাকে রিয়াংখোলা৷ একটু দূরে একটি ঝর্ণা নেমে এসেছে পাহাডে়র গা বেয়ে৷ জীবনের সব আনন্দ যেন ছডি়য়ে আছে রিয়াংখোলার পাড়ে৷ আশেপাশে পডে় থাকা নুডি়-পাথর জলের ধাক্কায় এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে এগিয়ে যায়৷ আকাশের নীল, পাহাডে়র বনভূমির সবুজ আর তারই মাঝে চঞ্চলা কিশোরীর ন্যায় রিমঝিম সুরে বয়ে চলা রিয়াংখোলার কাছে মনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়৷ মনে পডে় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘তখনো রিয়াংখোলা থেকে‘-র কিছু লাইন:”রিয়াংখোলার জলো মেঘটুকরো ওকের মাথায়৷ এখানে-ওখানে চষা চীনে-তুলসি,ধাপ-প্লানটেশন লাতপাঞ্চারের৷মানুষ এখানে হিম পরিবেশে, চাপে একত্র হবার জন্যে আসে৷ টিলা থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ভুবনভুলানো মূর্তি!”
ফেনিল জলধারার আনন্দলাহরীতে মেতে উঠব বলেই তো এখানে আসা! জলতরঙ্গের মিঠে সুরে বয়ে চলা নদীজলের একান্ত স্পর্শটুকু পাওয়ার লোভ পরিত্যাগ করতে না পেরে জলে নেমে খুব সন্তর্পনে এ পাথর ও পাথর ডিঙিয়ে পৌঁছে যাই একদম তার কাছে৷ চারিদিক পাথর দিয়ে ঘেরা এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব সুইমিংপুল! অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর সে৷ পাথর ও নুড়ির ওপর স্ফটিক-স্বচ্ছজল এক রূপকথার পরিবেশ গড়ে তুলেছে৷ এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও একঘেয়ে লাগে না৷ নদীপাডে়র নৈঃশব্দ্য মনকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়৷ যাঁরা নিরিবিলি বেড়ানোর জায়গা পছন্দ করেন তাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ৷
রিয়াংয়ের ওপর সকাল-বিকালের রং বদলের খেলা এখানকার প্রকৃতিকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে৷ অন্য সময় আপাত নিরীহ এই নদী নিরাপদ মনে হলেও বর্ষার সময় ভয়ংকর৷ অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে মাঝে মাঝে হরকা বান চলে আসে৷ তখন এই ছোট্ট নদীই হয়ে ওঠে ভয়ংকর খরস্রোতা৷ এ যেন একই অঙ্গে দুই রূপ! শীতকালে কিংবা ছুটির দিনে স্থানীয়রা আসেন চড়ুইভাতি করে নদীর পাডে় আসর জমাতে৷ বছরের যেকোন সময় নদীর রিনরিনে সুরের গান শোনার জন্য এখানে আসা যায়৷ ক্রমশই পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে রিয়াং৷ আশেপাশের কয়েকটি মাত্র ঘরবাডি়, দোকান আর দু’একটি হোমস্টে নিয়েই এই জায়গা৷ এখান থেকে যাওয়া যায় সিটং, অহলদারা, লাটপাঞ্চার, ঘালেটার, নামথিং পোখরি৷ অনেকে এখান থেকে ট্রেক করে চলে যান চিমনি, বাগোড়া৷ প্রকৃতিপ্রেমিক আর পক্ষীপ্রেমিক ট্রেকারদের কাছে এ পথ স্বর্গসম৷ শীতকালে উপরি পাওনা চতুর্দিকে ছেয়ে থাকা কমলালেবুর বাগান৷
নাগরিক জীবনের জটিলতায় অভ্যস্ত পর্যটকরা রন্ধে রন্ধ্রে উপভোগ করে নদীঘেঁষা গ্রামের এই নিরিবিলি পরিবেশ৷ নির্জনতা এখানে লাট খায়৷ পাশেই একটি চড়াই পথ৷ সেটি চলে গেছে তুরুক নামে আরেকটি গ্রামের দিকে৷ তুরুক গ্রামটি বেশ বর্ধিষ্ণু অঞ্চল৷ মেঘমুক্ত আবহাওয়া থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়৷ চায়ের দোকান থেকে এক কাপ কফি আর ম্যাগী নিয়ে রিয়াংয়ের পাশে এসে বসি৷ উষ্ণ কফিতে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে ভাবি রিয়াংখোলার কোলে যদি এক রাত কাটাতে পারতাম তাহলে বেশ ভালো হত৷ নদীর সাথে একলাই সুখ দুঃখের কথা মনে মনে বলতে থাকি৷ হঠাৎ চমক ভাঙে নিমা ভাইয়ার ডাকে, ‘ম্যাডামজি চলিয়ে৷ বরনা সিটং পৌঁছনে মে দের হো যায়গা৷’ রিয়াংকে কথা দিয়ে আসি অসমাপ্ত গল্পের বাকিটুকু অন্য কোনদিন এসে করব৷কী ভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে দুভাবে যোগীঘাট যাওয়া যায়৷ রোহিনী রোড, কার্শিয়াং, দিলারাম হয়ে, অথবা সেবক রোড, রম্ভি, মংপু, লাবদা হয়ে৷ দুটো রাস্তাতেই দূরত্ব শিলিগুড়ি থেকে ৭০-৭৫ কিমি৷ কার্শিয়াং ৩০-৩২ কিমি৷
কোথায় থাকবেন: রিয়াং নদীর সেতুতে ওঠার মুখেই আছে মুখিয়া হোম স্টে৷ জনপ্রতি, দিনপ্রতি থাকা-খাওয়ার খরচ সিজনভেদে ১২০০-১৫০০ টাকা৷ এছাড়া সিটংয়ে থাকা যায়৷