ভারতের নবজাগরণের পুরোধা পুরুষ ও সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায়

‘… তিনি নবীনের অভ্যর্থনা করিতে গিয়া প্রাচীন হইতে পা তুলিয়া লন নাই। হিন্দু জাতির কোথায় মহত্ব তিনি তাহা পরিষ্কার রূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, এবং তাহা সযত্নে বক্ষে ধারণ করিয়াছিলেন, অথচ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য নীতি ও পাশ্চাত্য জনহিতৈষণাকে অনুকরণীয় মনে করিয়াছিলেন’। প্রখ্যাত ব্রাহ্ম পণ্ডিত ও সমাজ সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রচিত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ এ যে মহাপ্রাণের সম্বন্ধে এই উক্তিটি করেছিলেন তিনি ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কারের অগ্রপথিক মহাত্মা রামমোহন রায়। প্রখ্যাত দর্শন বেত্তা ড. ব্রজ্রেন্দ্রনাথ শীলের মতে ‘রামমোহনই ছিলেন অগ্রদূত ও প্রকৃত অর্থে আধুনিক ভারতবর্ষের জন্মদাতা।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে লিখেছেন — ‘যদিও অজ্ঞানের আশক্তি জগদ্দল পাথর ভারতের বুকে চেপে আছে। লজ্জায় আমরা সংকুচিত। দুঃখে আমাদের দেহ-মন জীর্ন, অপমানে আমাদের মাথা অবনত, বিদেশের পথিক আমাদের কলঙ্ক কুড়িয়ে নিয়ে দেশে দেশে শিল্প পণ্যের ব্যবসা চালাচ্ছে, তবু আমাদের সকল দুর্নীতির ওপরে সর্বোচ্চ আশার কথা এই যে, রামমোহন রায় এদেশে জন্মেছেন, — রামমোহনকে না জানলে আমাদের আত্মপরিচয় অসমাপ্ত থাকে।’

উনিবিংশ শতাব্দী ‘ভারতের নবজাগরণের যুগ’। আর এই নবজাগরণের সুত্রপাত হয় রাজা রামমোহনের হাত ধরেই। দেশের শিক্ষা ও সমাজসংস্কার, ধর্মীয় দর্শন চিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের সমাহার ঘটে তাঁরই প্রচেষ্টায়। তাঁর যুক্তিবাদ, প্রগতীশীল চিন্তাধারা এবং সমাজে নারীদের সমান অধিকার দেওয়ার অদম্য মনোভাব আমাদের সর্বদা অনুপ্রাণিত করে। রামমোহনের মতে, ভারতবাসীকে অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কারে প্রাচ্যের শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।


ফ্রান্সিস বেকন, ভলতেয়ার, হিউম, নিউটন প্রমুখদের চিন্তাধারা এমনকি আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন, গ্রীকদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসী বিপ্লব রামমোহনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। তবে রামমোহন তাঁর যুগের চাইতে অনেক বেশি এগিয়েছিলেন। সেজন্য তাঁকে স্বদেশবাসী ও বিদেশিদের দ্বারা প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও নিজের অসীম সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং অনমনীয় দৃঢ়তায় সব বাধা অতিক্রম করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন প্রায় একক প্রচেষ্টায়। অনেকক্ষেত্রে অবশ্য সহায়তা পেয়েছিলেন বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের।

রামমোহনের প্রদর্শিত পথেই হেনরি ডিরোজিও ও বিদ্যাসাগরের মত যুক্তিবাদী, সংস্কারমুক্ত মানুষরা বাংলার নব-জাগরণের গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজে ছড়িয়ে পড়া কু-সংস্কার, জাতিভেদ, ধর্মান্ধতা, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি এবং অশিক্ষা’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন আধুনিক মনস্ক উদার চিন্তার যুক্তিবাদী এই মানুষটি।

পলাশীর যুদ্ধের পনেরো বছর বাদে ১৭৭২ সালে ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগরে জন্মগ্রহণ করেন রামমোহন। এঁদের আদিনিবাস ছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় এবং পরিবারটি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ শ্রেণিভুক্ত। রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের চাকরি গ্রহণের পর থেকেই ‘রায়’ উপাধি পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে তাঁদের ‘রায়’ পদবির ব্যবহার। রামমোহনের পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণব মতে বিশ্বাসী আর মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শৈব। জন্মসূত্রে রামমোহন ‘বৈষ্ণব’ ও ‘শাক্ত’ দুই প্রভাবশালী ধর্মীয় ঐতিহ্যের উত্তকরাধিকারী হয়ে ছিলেন। তবে উত্তরাধিকারী সূত্রে রামমোহন বাল্যকালেই তাঁর মায়ের অনেকগুলি গুণ পেয়েছিলেন।

শৈশব থেকেই রামমোহন অসাধারণ মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, কোনও কিছু একবার শুনলে তাঁর কণ্ঠস্থ হয়ে যেত এবং দ্বিতীয়বার তা শোনার প্রয়োজন হতো না। তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কথা পরবর্তী জীবনেও শোনা যায়। নানাবিধ কর্মে সর্বদা ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তিনি অনেকগুলি ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, যা প্রখর স্মৃতিশক্তি ছাড়া সম্ভব হোত না। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও রামমোহন বেশ কয়েকটি প্রাচ্য ভাষা—আরবি, হিন্দি, সংস্কৃত ও ফারসিতে উল্লেখযোগ্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। কিশোর বয়সেই মূল আরবিতে তিনি অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিডের গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন। ন্যায় শাস্ত্রেও তাঁর অসাধারণ অধিকার জন্মেছিল এবং তারই গুনণ পরবর্তীকালে তিনি একজন বীর তর্কযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। পাটনায় অধ্যয়নকালে রামমোহন ইসলোমের ধর্মগ্রন্থ কোরান ও সুফীদিগের কিছু গ্রন্থ অধ্যায়ন করেছিলেন যা তাঁর মানসিক বিকাশে যতেষ্ট সাহায্য করেছিল। বেদ ও উপনিষদের প্রতিও ছিল তাঁর দুর্বার আকর্ষণ। হিন্দুদের সনাতন প্রতিমা পূজা মেনে নিতে তিনি অস্বীকার করেন এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন।

পৌত্তলিকতায় অবিশ্বাসী হলেও তিনি একেশ্বরবাদী হওয়ায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে সরব হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন রামমোহন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা জগমোহনের স্ত্রী আলোকমঞ্জরী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে চাইলে রামমোহন বৌদিকে বাঁচানোর প্রাণপন চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হৃদয়হীন আত্মীয় ও ব্রাহ্মণদের হাত থেকে বৌদিকে শেষ পর্যন্ত রামমোহন উদ্ধার করতে পারেননি। ওইদিন বেদনায়, ক্ষোভে ও ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে রামমোহন বৌদির চিতার সামনে দাঁড়িয়ে শপথ করেছিলেন সমাজের ওই কুপ্রথার বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়বেন। ১৭ বছর পরে সেই প্রতিজ্ঞা রামমোহন পূরণ করেছিলেন। তবে বৌদির সহমরণের দৃশ্য রামমোহন জীবনভর ভুলতে পারেননি।
প্রচলিত ধর্মীয়-প্রথার বিরোধিতা করে এক সময় রামমোহন পিতা রামকান্ত রায়ের বিরাগভাজন হয়ে গৃহত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর।

গৃহত্যাগ করার পর রামমোহন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে লাগলেন। পাঞ্জাবে গিয়ে গুরুমুখী ভাষা শিক্ষার পর শিখ সম্প্রদায়ের ধমগ্রন্থগুলি গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন, একই সঙ্গে হিন্দি ভাষা রপ্ত করে দাদু ও কবীরের ধার্মিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর তাঁর মনে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম বৌদ্ধধর্মের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার আকাঙ্খা জাগলে তিনি হিমালয় অতিক্রম করে তিব্বতে পৌঁছান। সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করেন ঠিকই কিন্তু স্বীয় প্রকৃতি অনুসারে সেখানকার লামাদের মধ্যে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসগুলির বিরোধিতা করলে ধর্মান্ধ পুরুষেরা তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তিব্বতী রমনীদের প্রচেষ্টায় তিনি রক্ষা পান। তিব্বতী রমনীদের সেই সহৃদয়তার কথা তিনি জীবনে ভেলেননি এবং পরবর্তীকালে স্ত্রীজাতির প্রতি সারাজীবন শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গটি রামমোহন তাঁর নিজের ‘আত্মকথাতে’ উল্লেখ করেছেন। এর কয়েকবছর পরে হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে রামমোহন বারনসীতে পৌঁছান। ১৮০৩ সালে পিতা রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হলে তিনি মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। এখানে রামমোহন কর্মজীবনে প্রবিষ্ট হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব বিভাগে যোগদান করেন। ভাগলপুর, রামগড় ইত্যাদি স্থানে কাজ করার পর ১৮০৯-এ রংপুরের রেভিনিউ অফিসার জন ডিগবির অধীনে কাজ করতে থাকেন। কমর্জীবনের দীর্ঘকাল রামমোহন এই রংপুরেই কাটিয়েছিলেন। স্বীয় দক্ষতা ও ফার্মদক্ষতা গুনে সামান্য কোরানী থেকে রামমোহন শেষ পর্যন্ত কালেক্টরের দেওয়ান হয়েছিলেন।

ডিগবির অধীনে কাজ করতে করতেই রামমোহন ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও যত্নের সঙ্গে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন। অবসর সময়টা তিনি গভীর অধ্যায়ন ও আলোচনায় কাটাতেন। সে সময় তিনি বিলেত ও ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এবং ডিগবির দৌলতে সে দেশের পত্রপত্রিকাও পড়ার সুযোগের মাধ্যমে ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। এভাবেই তিনি ইউরোপের রাজনৈতিক উদারনীতির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বিশেষভবে উল্লেখ্য যে, কালেক্টর ও দেওয়ান (ডিগবি ও রামমোহন) উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যার ফলে পরবর্তীকালে প্রভু ভৃত্যের সম্বন্ধ মুছে গিয়ে তাঁদের দু’জনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রামমোহনের কর্মজীবনে যা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। যাইহোক, ১৮১৪ সালে ডিগবি চিরদিনের জন্য ভারতবর্ষ ত্যাগ করলে রামমোহনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে। কলকাতায় এসে রামমোহন তাঁর জীবনের এক নতুন পর্ব শুরু করেন। স্থির সিদ্ধান্ত নেন নিজের জীবনকে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করবেন। নিজের দেশের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকের পথে, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে আধুনিককালের যুক্তিসিদ্ধ জীবনের পথে উত্তীর্ণ করার জন্য, একাকী তিনি যে সব সংস্কারমূলক প্রয়াসে অগ্রণী হয়েছিলেন—তা সহজে ধারণা করা যায় না। ‘শাস্ত্র’ ও ‘যুক্তি’ এই দুটির মাধ্যমেই রামমোহন স্বজাতির মত পরিবর্তন ও তাদের মননের সংস্কারসাধন করতে চাইলেন। আর এই কাজে অগ্রসর হতে গিয়ে তিনি জীবনের বাকি ১৮ বছর অনুবাদ কর্মে ব্যপৃত হয়েছিলেন। রামমোহন প্রথম উদ্যোগেই সংস্কৃত বেদান্ত সূত্রের ভাষ্য বাংলায় অনুবাদ করে ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ নামে প্রকাশ করেন। এর কিছুকাল পরে সর্বসাধারণের বোধগম্য করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ‘বেদান্তসার’ (১৮১৬)।

‘বেদান্তসার’ই এক এর্থ সে সময়ে হয়ে উঠেছিল বঙ্গীয় নবজাগরেণের উৎস। অন্ধকারাচ্ছন্ন সে সময়ে সমাজে প্রচলিত ধর্ম বলতে রামমোহন লক্ষ্য করলেন যে কেবল অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠান, বিকৃত মন্ত্রতন্ত্র, দুর্গোৎসবে বলিদান, নন্দোৎসবে কীর্ত্তন এ সমস্ত বাহ্যিক আড়ম্বর ও আচারে হিন্দুধর্ম আচ্ছন্ন। বেদান্ত চর্চা দেশ থেকে প্রায় লুপ্ত। সাধারণ মানুষ সংস্কৃতে লিখিত শাস্ত্র গ্রন্থের মর্মোদ্বার করতে অক্ষম। এমতাবস্থায়, বাংলাভাষায় প্রচীন শাস্ত্রের আলোচনার মাধ্যমে বেদান্তচর্চার পুনঃপ্রবর্তন দ্বারা জনসাধারণের যথার্থ ধর্মবোধ উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজন অনুভব করে সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অদম্য কর্মশক্তি নিয়োগ করেন রামমোহন। প্রকৃত ধর্মোপলব্ধি ও ধর্মের প্রচারেই তাঁর ধ্যান, মনন ও প্রচেষ্টা নিত্য নিয়োজিত ছিল।

রামমোহনের সাহিত্য ও অনুবাদ চর্চা ছিল মূলত সমাজ সংস্কারভিত্তিক মানবতাবাদী আন্দোলন। তাঁর রচিত প্রায় তিরিশটি (৩০) গদ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অনুবাদ-গ্রন্থ, বিতর্ক ও বিচারবিষয়ক গ্রন্থ এবং কিছু মৌলিক রচনা।ষ অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য; বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, পঞ্চ-উপনিষদ।

রামমোহনের অন্যান্য অনুবাদের মধ্যে রয়েছে ‘গায়ত্রীর অর্থ (১৮১৮), আত্মানাত্মবিবেক (১৮১৯), ব্রজসূচী (১৮২৭)। তবে এসব অনুবাদ গ্রন্থ-এ ব্যাপৃত থেকেও তিনি তৎকালীন সমাজের হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে বন্ধ করতে একমাত্র সংবাদ মাধ্যমকেই প্রধান অস্ত্র করেছিলেন। তাঁর প্রতিবাদী কলম বারংবার ঝংকার দিয়েছে সমাজের ধর্ম ও সংস্কৃতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিরোধে যুক্তিনির্ভর ও গোঁড়ামিমুক্ত বক্তব্যে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়. ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে এসে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে অবস্থার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করেন। যার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে এগিয়ে আসেন রামমোহন সহ একাধিক বুদ্ধিজীবী মহল। হিন্দু ধর্মের প্রতি অযৌক্তিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ১৮২০-র সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করলেন ইংরেজিতে ‘Brahmanical Magazine’ এক পৃষ্ঠায়, অন্য পৃষ্ঠায় ‘ব্রহ্মণ সেবধী’, যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এ ব্যাপারে তাঁর পরবর্তী প্রয়াস ১৮২১-এ ‘সম্বাদ কৌমুদী’ প্রকাশ। পত্রিকাটি তারাচাঁদ দত্ত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাংলা সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে প্রথমে। রামমোহন সে সময়ে ‘সম্বাদ কৌমুদীর সম্পাদক না থাকলেও তিনিই ছিলেন পত্রিকাটির প্রাণপুরুষ। তাঁর নির্দেশিত নীতিতেই পত্রিকাটি পরিচালিত হত। তবে কিছু সময় পরে রামমোহনের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে ভবানীচরণ ওই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিলে রামমোহন নিজেই তার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘সম্বাদ কৌমুদীকে’ কেন্দ্র করেই রামমোহনের সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ। এছাড়া ১৮২২ সালে রামমোহন ‘মিরাৎ-উল-আখ্বার’ নামে একটি ফার্সী সংবাদপত্রও পরিচালনা করতেন। পরে অল্প সময়ের জন্য রামমোহন তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ নামক একটি চতুর্ভাষী (ইংরেজী, বাংলা, হিন্দী ও ‘ফার্সী) সাপ্তাহিক পত্রের স্বতাধিকারী হয়েছিলেন। রামমোহন সাংবাদিকতা করতেন জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে। জনসাধারণের অভাব, অভিযোগ, দাবি প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা, সমাজের উদার শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা, বিশ্বরাজনীতিতে জনমতকে শিক্ষিত করে তোলা এবং সর্বোপরি সতীদাহ ও অন্যান্য সামাজিক অনাচার ও জাতীয় কলঙ্কের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা—এসব ছিল রামমোহনের সংবাদপত্র পরিচালনের উদ্দেশ্য। সংবাদপত্রের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রামমোহন পবিত্র অধিকার অধিকার বলে মনে করতেন। তাই যখন ১৮২৩ সালে অস্থায়ী গর্ভনর জন অ্যাডাম্স সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রণয়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল রামমোহনের কণ্ঠে।
দেশে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের কাজেও রামমোহন ছিলেন তাঁর কালের অগ্রণী পুরুষদের অন্যতম। এ কাজে তিনি জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী বিচার করতেন না; নির্বিচারে সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন। ১৮১৭ সালে কলকাতায় ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হবার আগের বছর তিনি হিন্দু ছেলেদের শিক্ষার জন্য সম্পূর্ণ নিজের খরচে এক বিদ্যায়ে স্থাপন করেন। প্রায় ছ’বছর পর ওই প্রতিষ্ঠানটিকেই সংস্কার করে তিনি বিখ্যাত ‘অ্যাংলো-হিন্দু’ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। ১৮২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে শিক্ষা বিষয়ক তাঁর বিখ্যাত পত্রটি লেখেন ওই পত্রে প্রস্তাব ছিল শিক্ষার খাতে সরকারি টাকা একটা সংস্কৃত কলেজ স্থাপনে ব্যয় না করে ওই অর্থে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হোক যা মানেুষের বাস্তব জীবনে যুগোপযোগী প্রয়োজন মেটাতে পারে। সরকার অবশ্য তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রসূত ওই যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবে কান দেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে মেকলের শিক্ষাবিষয়ক ব্যবস্থালিপি গৃহীত হলে রামমোহনের স্বপ্ন সফল হয়েছিল ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন কলকাতায় নিজের খরচে একটি বেদান্ত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় তাঁর স্কুল-ভবন স্থাপন করার জন্য বাড়ির অভাবে বিব্রত তখন রামমোহন তাঁকে বাড়ি ও স্কুলের জন্য ছাত্র জোগাড় করে দিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজের মতই ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে রামমোহনকে সুপরিকল্পিতভাবে ভাবে দূরে রাখা হয়েছিল। তবুও সে প্রতিষ্ঠানের অনুরোধেই তিনি রচনা করে দিয়েছিলেন ‘ভূগোল’ বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক, সংশোধন করে দিয়েছিলেন ‘জ্যোর্তিবিদ্যা’ বিষয়ক ইংরেজি গ্রন্থের বJঙ্গানুবাদের পাণ্ডুলিপি। শিক্ষা বিস্তার সংক্রান্ত কাজে রামমোহনের ক্লান্তি ছিল না।

রামমোহনের জীবনের শেষ তিন বছর (১৮৩০-৩৩) কাটে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডে তিনি প্রতিনিয়তই কর্মব্যস্ত থাকতেন। ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের উত্তোরত্তর অবনতি ঘটে। অবশেষে ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টলে তাঁর মৃত্যু হয়। এক ইংরেজ জীবনীকার সত্যই বলেছেন, ‘রামমোহন ভারতের গৌরবময় অতীত ও অনন্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মধ্যে জীবন্ত সেতুস্বরূপ।