ত্রিপুরার তৃণমূল নিগ্রহের অগ্নিতপ্ত আবহে বুধবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল বিএসএফ-এর এন্ডিয়ার বৃদ্ধি এবং রাজ্যের কেয়া দাবিদাওয়ার ইস্যু নিয়ো মোদি-মমতার আলোচনা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এদিনের বৈঠক জুড়ে রইল রাজনৈতিক সৌজন্যের উন্নতা।
আগামী এপ্রিল মাসে রাজ্যের বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানালেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্দি’র সঙ্গে বৈরিতা তৈরি হয়েছিল মোদির তা বদলে সখ্যতায়।
এই বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ব্যাথা দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক মতবিরো থাকতে পারে, কিন্তু তার আঁচ যেন উন্নয়নের সম্পর্কে না এসে পড়ে। এই আমন্ত্রণকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৌশলী পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মোদির সঙ্গে বৈঠক শেষে বুধবার দিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, কেন্দ্র ও রাজা দুটি দল চালায়। দু’জনের মধ্যে মতাদর্শগত ফারাক থাকবেই। কিন্তু এর প্রভাব কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ওপর পড়া উচিত নয়।
রাজ্যগুলির উন্মরন হলেই কেন্দ্রের উন্নতি সম্ভব তাই ২০-২১ এপ্রিল কলকাতায় বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কয়েক বছর বন্ধ থাকার পরে এই রাজ্যে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন হতে চলেছে আগামী ২০-২১ এ সেই সম্মেলনের উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রী সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র-রাজ্যের একযোগে কাজ করার বার্তা শিল্পপতিদের সামনে তুলে ধরতেই এই উদ্যোগ, বলে জানিয়েছেন মমতা। এই আমন্ত্রণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ইতিমধ্যেই নানা জল্পনা শুরু হয়েছে।
যে বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন নিয়ে রাজ্যে রাজক নবান্নের বিরোধ লেগেই থাকে। রাজ্য বিজেপিশু এই সম্মেলনের সমালোচনা করে থাকেন। সেই সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদিকে কি নিছকই সৌজন্যের খাতিরে আমন্ত্রণ জানালেন? নাকি এর নেপথ্যে কোনও রাজনৈতিক চাল রয়েছে?
মমতা অবশ্য এদিন নিজেই ব্যাথা নিয়েছেন এই বিষয়ে। মমতার কথায় কোভিডের জন্য এমনিতেই শিক্ষার হাল খারাপ হয়েছে গত বছরে। বিদেশ থেকে ক’জন শিল্পপতি অসতে সম্মত হবেন জানা নেই।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র রাজ্য যৌথভাবে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলে শিল্পপতিদের কাছে ভালো বার্তা যাবে। প্রয়োজন অন্য রাজ্যগুলোও এতে অংশ নিতে পারবে। যার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
আর এইভাবে বাংলা নতুন করে শিল্পে দিশা দেখাতে পারবে। প্রসঙ্গত পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের খরা কাটাতে এবং বিদেশি লগ্নির আশায় এর আগেও রাজ্যপাল জগদীপ ধকড়কেও বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা। বিভেদ ভুলে সাংবিধানিক পদমর্যাদাকে সম্মান জানিয়ে তাকেও ডাক পাঠিয়েছিলেন।
এমনকী বিদেশে গিয়ে বাংলার শিল্পের জন্য সওয়াল করার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এবার আমাণের তালিকায় প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে শিল্প সম্মেলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইলেন মমতা। এই আমন্ত্রণকে অবশ্য কটাক্ষ করেছেন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী।
বুধবার তিনি বলেন, মমতা বলেছিলেন বিএসএফ নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু জানিয়ে এলেন আমসুল। কেন্দ্রের নীতি দেখে যা শিল্পপতিরা ব্যবসা গোটাতে চাইছে এদেশ থেকে তখনই মমতা বাংলার শিল্প সম্মেলনের উদ্বোধন করাতে চাইছেন মোদিকে দিয়ে।
এর থেকে বোঝা যায়, উনি (মা) মোদিজিকে জেতানোর জন্য কতটা মরিয়া সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও মোদি-মমতার এই সাক্ষাৎকার নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, নরে মোদির সঙ্গে বৈঠকে রাজ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থে মোদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন মমতা।
তবে বিরোধীরা যাই বলুন, বিএসএফ-এর এভিয়ারবৃদ্ধি নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মমতার কথায়, আমরা বিএসএফ-এর বিরোধী নই। কিন্তু তাদের এক্তিয়ারবুদ্ধিতে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সংঘাত ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিঘ্নিত হতে পারে। কয়েকদিন আগেই কোচবিহারে বিএসএস-এর গুলিতে কয়েকজন মারা গিয়েছেন।
সেই ঘটনার কথা বলে বিএসএফ-এর এক্তিয়ারবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়া এদিন মোদি-মমতা বৈঠকে বাংলার ভ্যাকসিন বরাদ্দ বৃদ্ধির কথাও উঠেছে। রাজ্যে স্কুল খুলে গিয়েছে। এই অবস্থায় ১২ থেকে ১৮ বয়সীদের টিকাকরণ নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া ৯৬ হাজার কোটি টাকা। সেই বকেয়া টাকার জন্যও মোদির কাছে দরবার করেছেন মমতা। পাশাপাশি আমান, ইয়াস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন মমতা বলেছেন, টাকা না পেলে রাজ্য চলতে অসুবিধে হচ্ছে।
এদিন পাট শিল্পের উন্নয়ন ও মোদি-মমতার কথা হয়েছে। মমতার কথায়, দেশের ৪২ শতাংশ পাট উৎপন্ন হয় রাজ্যে। কিন্তু পাট মজুত করার ওপরে একটা নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছে কেন্দ্র ফলে রাজ্যের পাটচাষীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পার্টি কিনে না।
জুট করপোরেশন অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। তবে এদিন মোদি-মমতা বৈঠকের মূল অ্যাজেন্ডাও বাদ যায়নি উভয়ের বৈঠকে। বিশেষ করে এই বৈঠকের পরে রাত পোহালেই যখন ত্রিপুরায় পুরভোট, তা ত্রিপুরায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়ে সরব হবেন মমতা, সেটাই ছিল প্রত্যাশিত।
এদিনের বৈঠকের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের সামনে বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, ত্রিপুরায় এসব কী হচ্ছে। সায়নী ঘোষ একজন জনপ্রিয় শিল্পী তার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। এখানে গণতন্ত্র বিপন্ন।
প্রসঙ্গত বাংলায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়ে মোদি অমিত শাহরা বহুবার সরব হয়েছেন। বাংলায় কেন্দ্রীয় সরকারের টিম পাঠিয়েছেন অমিত শাহ এবার বিজেপি শাসিত রাজ্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়েই খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানালেন তৃনমূল সুপ্রিমো। রাজনীতিতে এই অবস্থান আর অবস্থা- উভয়ের বদলই ঘটে যায় স্বাভাবিকভাবে।