কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আজ সংসদে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে যে, সরকার এখনও সারা দেশে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) রূপায়ণ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজ লােকসভায় এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই বলেছেন, এখনও পর্যন্ত সরকার জাতীয় পর্যায়ে এনআরসি করার কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। নাগরিকত্ব সংশােধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্যেই সরকার আজ এই ব্যাখ্যা দিল, যদিও অতীতে সরকার বলেছিল, এনএএ রূপায়ণের পরই এনআরসি হবে।
আজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা সহ শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের বক্তব্য থেকে সরে আসারই ইঙ্গিত বহন করছে। ২০১৯-র লােকসভা নির্বাচনে বিজেপির ইস্তেহারেও দেশের অন্যান্য অংশে ধাপে ধাপে এনআরসি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি ঝাড়খণ্ডে এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছিলেন, তাঁর সরকার সারা দেশে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করার বিষয় নিয়ে কোনও আলােচনাই করেনি। সারা দেশে ডিটেনশন সেন্টার করার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস ও তার মিত্র দলগুলি, কিছু শিক্ষিত নকশাল ও শহুরে নকশাল এইসব কথা প্রচার করছে’।
পরবর্তী সময়ে সংবাদ সংস্থা এএনআই ও নিউজ চ্যানেল এবিপি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন। তিনি বলেন, এনপিআর-এর তথ্য এনআরসি’র জন্য ব্যবহার করা হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক বিবৃতি জারি করে বলেছে, ‘এনপিআর তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশে এনআরসি করার কোনও প্রস্তাব এই মুহূর্তে নেই’।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) হচ্ছে এক তালিকা, যার সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৩ সালে ১৯৫৫ নাগরিকত্ব আইন সংশােধনের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য হল ভারতের বৈধ নাগরিকদের একটা তালিকা তৈরি করা, যাতে বেআইনি অভিবাসীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানাে যায়। এনআরসি প্রক্রিয়া অসমে চালু করা হলে গত বছর সেখানে প্রকাশিত চুড়ান্ত তালিকা থেকে ১৯ লক্ষের বেশি আবেদনকারীর নাম বাদ পড়ে।
তারপর গত ডিসেম্বরে সংসদে সংশােধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাশ হওয়ার পর সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জির (এনপিআর) জন্য ২৯০০ কোটি টাকা অনুমােদন করে। সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর নিয়ে প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে অনেকেরই মনে হয়েছে এগুলি এনআরসি’র লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ, যদিও সরকার দু’টি বিষয়কে আলাদা করে দেখাতে চেয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই এদিন লােকসভায় একথাও পরিষ্কার করে দেন যে, এনপিআর প্রস্তুত করার সময় কোনও নথিপত্র চাওয়া হবে না। এই প্রক্রিয়ায় আধার নম্বর দেওয়াটাও স্বেচ্ছামূলক। এনপিআর তৈরির প্রশ্নে যেসব উদ্বেগের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে কথা বলছে। এনপিআর তৈরির সময় জনবিন্যাস এবং প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তির বিবরণে নথিভুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
শ্রীরাই আরও বলেন, এনপিআর ২০২০ তৈরির সময় গণনাকর্মী ও তদারককারীদের জন্য একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। জনগণ যেটুকু জানে, সেই তথ্যই এনপিআর-এর জন্য দেবে। এর জন্য কোনও নথিপত্র চাওয়া হবে না। এনপিআর তৈরির সময় কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে কিনা, তা যাচাই করা হবে না।
১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ এনপিআর-এর কাজ চলবে। সেই সময় ২০২১-এর জনগণনার (সেন্সস) জন্য সমস্ত বাড়ি চিহ্নিত করার কাজও হবে। শ্রীরাই বলেন, এনপিআর-এর জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হবে। যতটা সত্য জানা আছে সেটুকু তথ্য দিলেই হবে। আধার নম্বর দেওয়াটা স্বেচ্ছামূলক। জনসংখ্যা তালিকায় নাগরিকদের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর পুর্ব ও অ-বিজেপি রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের এনপিআর ফর্ম, তার প্রশ্নমালা ইত্যাদি ভালাে ভাবে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই প্রক্রিয়া একটা ভয়ঙ্কর খেলা, কারণ এতে পিতামাতার জন্মের বিস্তৃত তথ্য ও বসবাসের প্রমাণ পাওয়া হয়েছে।
কেরল সরকার ঘােষণা করেছে যে তারা জনগণনার (সেন্সাস) প্রক্রিয়া রূপায়ণ করবে, কিন্তু এনপিআর-এ সহযােগিতা করবে না। কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এনপিআর যেহেতু এনআরসি’র আগের ধাপ, তাই জনগণের মধ্যে একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেরলে এনপিআর ও এনআরসি রূপায়ণ করতে গেলে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখা দেবে। এনআরসি যে রাজ্যে রূপায়ণ করা হয়েছে সেখানে এই অভিজ্ঞতাই হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাস খানেক আগে কংগ্রেস সভানেত্রী সােনিয়া গান্ধির নেতৃত্বে প্রায় ২০টি দল দিল্লিতে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেসব মুখ্যমন্ত্রী তাদের রাজ্যে এনআরসি রূপায়ণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের এনপিআর-এর কাজ বন্ধ রাখার জন্যও আবেদন জানানাে হবে। কারণ এনপিআর হচ্ছে এনআরসি’রই ভূমিকা মাত্র।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, সংশােধিত নাগরিকত্ব আইন, ২০১৯ বলবৎ হয়েছে ২০২০-এর ১০ জানুয়ারি। কেন্দ্রীয় সরকার যথাবিহিত নিয়মবিধি ঘােষণা করার পর নাগরিকত্বের জন্য এই আইনের আওতায় আবেদন করা যাবে। সংশােধিত নাগরিকত্ব আইন প্রণীত হওয়ার পর ডিটেনশন সেন্টারগুলি থেকে আটক অভিবাসীদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ জারি করেনি বলে তিনি জানান।