নিরালা সৌন্দর্যের উৎস লেহ’র উলেটোকপো গ্রামে 

শ্যামাশ্রী দত্ত  
বেড়াতে যারা ভালবাসেন ভারতের শীতল মরুর শহর লেহ তাদের কাছে স্বর্গরাজ্য৷ লেহ’তে পৌঁছনো মাত্র মনে হয় যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছি৷ মধ্য এশিয়ার অনিন্দ্যসুন্দর ভূমিরূপের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে সর্বত্র৷ চারিদিকে ঊষর ধূসর কারাকোরাম পর্বতশ্রেণী, মাঝে মাঝে সবুজ পপলারের সারি, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছবির মতো সুন্দর সুসজ্জিত নানান বৌদ্ধ মঠ, আর উছল ধারায় এঁকেবেঁকে বয়ে চলা পান্না রঙের সিন্ধু নদী – রূপকথার কল্পরাজ্যও হার মেনে যায় এই বর্ণিল শোভার কাছে৷ যেকোনও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মতোই লাদাখ দেখার স্বপ্নটা আমার মস্তিষ্কেও বাসা বেঁধে ছিল বহুকাল৷ আকাশপথে লেহ শহরে পৌঁছে প্রথম দিনটা কাটল হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে, কারণ লেহ’তে পৌঁছে উচ্চতার সাথে শরীরকে মানিয়ে নেওয়াই হল প্রথম কাজ৷ বিশ্রামের অবসরে লাদাখের ইতিহাস ভূগোলের উপর একবার সংক্ষেপে চোখ বুলিয়ে নেওয়া গেল৷ প্রাচীনকাল থেকে বারবার শাসকের বদল ঘটেছে ভারতের মানচিত্রের এই উত্তরতম প্রান্তে; কখনও তিব্বতী, কখনও মুসলিম আবার কখনও ডোগরা রাজাদের অধীনস্থ হয়েছে লাদাখ৷ তবে লাদাখের সমাজ, জীবন ও ধর্মে তিব্বতী সংস্কৃতির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি৷ বর্তমানে লেহ এবং কার্গিল এই দুই জেলা নিয়ে লাদাখ গঠিত৷
উত্তরে কারাকোরাম এবং দক্ষিণে গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জের মধ্যবর্তী ভারতের এই সর্বোচ্চ মালভূমির বেশিরভাগ অঞ্চলের উচ্চতাই ৩০০০ মিটারের উপরে৷  দ্বিতীয় দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম ৩৫০০ মিটার উচ্চতার লেহ শহর ঘুরে দেখতে৷ ধূসর পাহাড়ের কোলে প্রাচীন বৌদ্ধ-রাজত্বে পথের ধারে সাদা স্তূপ, পাকদণ্ডী পথের আঁকেবাঁকে ঐশ্বরিক মগ্নতায় রঙবেরঙের প্রার্থনা পতাকাগুলোর অনাবিল উড়ে চলা, তিব্বতী শৈলীর বহু পুরোনো রাজপ্রাসাদ, কেল্লা ও ঘরবাড়ি নিয়ে লেহ’র মন্ত্রমুগ্ধ করা প্রতিটি দৃশ্যেই নান্দনিকতা ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব যুগলবন্দি৷ লেহ প্যালেস, শান্তিস্তূপ, লেহ’র ঐতিহাসিক লোকাল মার্কেট ঘুরে পৌঁছলাম লেহ’র পশ্চিমদিকে সিন্ধু ও জাঁস্কর নদীর অপরূপ সঙ্গমে৷ তারপর একে একে বিস্ময়কর ম্যাগনেটিক হিল, ভারতীয় সেনার বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত ‘হল অফ ফেম’, গুরুদ্বারা পাথর সাহিব এবং দুটি বিখ্যাত বৌদ্ধ গুম্ফা লিকির ও আলচি মঠ দেখে লাঞ্চ পর্ব মিটিয়ে সেদিন বিকেল নাগাদ এসে পৌঁছলাম লেহ জেলার শাম ভ্যালির উলেটোকপো গ্রামে৷ লেহ-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে, লেহ থেকে ৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে এক অনাবিল সৌন্দর্যের খনি এই গ্রাম৷ আমাদের গাড়ি এসে থামল এক ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের সামনে৷ উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে সারি সারি তাঁবুর ঘর, দেখেই মনটা অ্যাডভেঞ্চারের আশায় আনন্দে নেচে উঠল৷
উলেটোকপো’র এই টেন্ট কটেজগুলোতে ট্রেকার আসেন বছরভর, কাছাকাছি কয়েকটি হাই-অলটিচিউড মাউন্টেন-পাসে ট্রেক করেন তাঁরা৷ লাদাখের উচ্চতর স্থানে যাওয়ার আগে শরীরকে উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতেও লেহ’র কাছকাছি ৩০৪৮ মিটার উচ্চতার এই গ্রামটি দু-এক দিন থাকার জন্য আদর্শ৷ মাথার উপর উজ্জ্বল নীল আকাশে সাদা মেঘের খেয়া৷ চারিদিকে ধূসর পাহাড়ের বেষ্টনী, মাঝে মাঝে পপলার আর অ্যাপ্রিকট গাছগুলো রুক্ষতার বুকে একটুখানি স্নিগ্ধতার আশ্বাস হয়ে জেগে আছে৷ সবটাই এক অদৃশ্য চিত্রকরের তুলির টানে ফুটে ওঠা ছবি যেন৷ গ্রামের পাশে গভীর খাদ বেয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী৷ পৌঁছেই জিনিসপত্র তাঁবুর ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের রাস্তা ধরে৷ উঁচু নীচু আলপথের দুধারে আপেল গাছগুলো শেষ শরতে টুকটুকে লাল আপেলে বোঝাই হয়ে আছে৷ শীতের প্রাক্কালে পপলারের কিছু পাতায় হলুদ রঙের ছোঁয়া লেগেছে৷ আকাশের নীল, পাহাড়ের ধূসর, গাছের সবুজ, হলুদ, লাল – প্রকৃতির এই রঙবাহারী কোলাজে চোখে যেন ঘোর লেগে যায়৷ গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকেই ইতিউতি গ্রামবাসীদের কুটির৷ সাড়া পেয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন অনেকে৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখান  ঘরবাড়ি, বাগান নিয়ে তাদের সহজ সুরে বাঁধা জীবনযাত্রার ছবি৷ অস্তগামী সূর্য পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছে অনেকটা৷ সিন্ধুর জলে গোধূলির লাল আলোর মাখামাখি দেখতে দেখতে ফিরে এলাম তাঁবুর ঘরে৷  সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কটেজের খোলা চাতালে বসে আকাশে চোখ তুলতেই সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু নজরে এল৷ ঘন নীল সন্ধের আকাশে ফুটি ফুটি অনেক তারার মেলা বসেছে৷ তার মধ্যেই ধোঁয়াটা ক্রমশ বড় হচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি তাঁবুর আলোগুলো নিভিয়ে, ক্যামেরা আর ট্রাইপড হাতে নিয়ে চাতালে এসে দাঁড়াতেই চোখের সামনে এক অখণ্ড বিস্ময়! বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত রূপের মহিমা তখন ছায়াপথের আকারে আবির্ভূত হয়েছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত জুড়ে৷
মহাজগতের অপার রহস্য ‘আকাশগঙ্গা’র নীচে দাঁড়িয়ে খালি চোখে অসীম ব্রহ্মাণ্ডের বিশ্বরূপ দেখতে দেখতে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে গেলাম ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে’৷ ক্ষণকালের জন্য এক অপার্থিব দৃশ্যের রচনা করে ছায়াপথ আবার বিলীন হয়ে গেল অসীম আকাশের সীমাহীন চরাচরে, শুধু সঞ্চয়ে রয়ে গেল এক অবিস্মরণীয় অনুভব, আজীবনের জন্য৷  পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল পাখিদের সুরেলা শিস আর সিন্ধুর তরঙ্গ স্রোতের আওয়াজে৷ এবার বিদায়ের পালা৷ রাতের তারাভরা আকাশ, সিন্ধুর পান্না-সবুজ জল, আর ধূসর পাহাড়ে সাজানো উলেটোকপো’র মনমাতানো সৌন্দর্যের মাঝে কাটানো কিছু বিরল মুহূর্তের রঙিন রূপকথায় হৃদয় পূর্ণ   করে গাড়িতে উঠে বসলাম পরবর্তী গন্তব্যের জন্য৷প্রয়োজনীয় তথ্যঃ-
কীভাবে যাবেন – আকাশপথে অথবা সড়কপথে লেহ পৌঁছে গাড়ি নিয়ে সহজেই আসা যায় উলেটোকপো৷ সময় লাগে ঘণ্টাখানেক৷
কখন যাবেন – লাদাখের অন্যান্য জায়গার মতোই উলেটোকপো যাওয়ার ভালো সময় হল মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস৷ বাকী সময়ে হিমাঙ্কের অনেক নীচে থাকে তাপমাত্রা৷
কোথায় থাকবেন – উলেটোকপো’তে থাকার জন্য হোমস্টে এবং টেন্ট কটেজ দুইই পাবেন৷ কটেজগুলোর প্রাঙ্গণে কিচেনে খাওয়ার সুবন্দোবস্ত থাকে৷
সঙ্গে রাখবেন – উচ্চতাজনিত অসুবিধা কাটাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন৷ গ্রীষ্মে উলেন পোশাক, হালকা জ্যাকেট, টুপি এবং স্নিকার্স যথেষ্ট; তবে নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে গেলে হিমাঙ্কের নীচে থাকার সমস্তরকম প্রস্তুতি নেওয়া বাধ্যতামূলক৷ প্রখর সূর্যালোক এড়াতে সব ঋতুতেই সানগ্লাস ও সানস্ক্রিন প্র্র্য়োজনীয়৷
কি করবেন এবং করবেন না – উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতে লেহ পৌঁছে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন৷ গুম্ফায় লামাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং গুম্ফার পরিবেশ ও পবিত্রতা বজায় রাখা অবশ্য কর্তব্য৷ বিরল সৌন্দর্যের লাদাখের প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখতে প্লাসটিক ফেলা থেকে একান্তভাবেই বিরত থাকুন৷