মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের লড়াই শুরু করার সময় বুঝি দরজায় কড়া নাড়ছে। গোটা দেশের পরিস্থিতি এবং একের পর এক নির্বাচনী ফলাফল সেই পথের দিকেই আঙুল দেখাচ্ছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে দেশে একটার পর একটা নির্বাচনে প্রমাণ হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী আর ‘জনপ্রিয়’ মুখ নন। বিজেপির পালেও সেভাবে হাওয়া নেই। তাদের সব অহং ঝেড়ে ফেলে, আঞ্চলিক দলগুলির ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে।
আবার উল্টোদিকে কংগ্রেস নিজেকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের একমাত্র সর্বভারতীয় দল বলে জাহির করলেও, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তারা বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ছে। আঞ্চলিক সঙ্গী ছাড়া কংগ্রেসেরও অধিকাংশ রাজ্যে নিজের শক্তিতে চলার ক্ষমতা নেই। অথচ, তারা হাবেভাবে আঞ্চলিক দলগুলিকে উপেক্ষাই পছন্দ করে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর একদলীয় শাসনের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর বিজেপি লোকসভায় একক গরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ করেছে। নামেই ছিল এনডিএ সরকার। জোটের শরিকদের কোনও অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত না। কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি দপ্তরে বিভিন্ন শরিক দলের কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু তাঁদের কোনও গুরুত্ব ছিল না। বামফ্রন্টের জমানায় বাংলায় সিপিএমের একদলীয় শাসনের মতোই। কিল খেয়ে কিল হজম করে বসে থাকতে হত বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিকদের। সরকারের নীতি নির্ধারণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কোনও কিছুতেই শরিক দলগুলি পাত্তা পেত না। ঠিক যেমন ছিল এখানে বামফ্রন্টের শরিকদের অবস্থা। সিপিএমের অঙ্গুলিহেলনে চলাই ছিল তাদের ভবিতব্য।
২০২১ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর কেবল কেন্দ্রে নয়, গোটা দেশের ছবিটাই পাল্টে গেল। নরেন্দ্র মোদীর পেটোয়া কীর্তনিয়ার দল বোল তুলেছিল, বিপুল জনাদেশ নিয়ে বিজেপি ফের ক্ষমতায় ফিরছে। সর্বশক্তি নিয়ে সেই আনন্দে ভোটের প্রচারে মোদীকে মুখ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গেরুয়া শিবির। সিংহভাগ মিডিয়া সুর ধরেছিল, মোদী বিনা গীত নেই! এমনকি ভোটের ফল, আগাম হিসাবে সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ঝড় বইয়ে দেওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লোকসভায় প্রবেশ করবে।
কিন্তু ইভিএম মেশিন খুলতে দেখা গেল সেসব হিসাব ছিল মনগড়া। অভিযোগ উঠেছিল, মোদী অ্যান্ড কোম্পানি বিভিন্ন মিডিয়া হাউসকে ‘ম্যানেজ’ করে নিজেদের পক্ষে হাওয়া তুলতেই এই চেষ্টা চাপিয়েছিল। কিন্তু সবই বৃথা যায়। বিজেপি লোকসভার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা থেকে অনেকটা দূরেই থেকে যায়। ফলে এনডিএ শরিকদের গুরুত্ব ফিরে আসে। তারপর থেকে পদ্ম শিবির ‘মোদীর জয়’ বলে আর কোনও স্লোগান দেয় না।
হালে দেশে যেসব রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়েছে, ছোট রাজ্য হরিয়ানা বাদে কোনও বিজেপি নিজের জমিতে জিততে পারেনি। সদ্য সমাপ্ত ভোটে মহারাষ্ট্রে দুই শরিক একনাথ শিণ্ডের শিবসেনা এবং অজিত পাওয়ারের এনসিপি-র কাঁধে ভর করে তাদের জিততে হয়েছে। ঝাড়খণ্ডে তো পদ্মফুলের পাপড়ি খসে গিয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপির ফল এমন কিছু আহামরি নয়। অর্থাৎ মোদী ব্র্যান্ড আর বাজারে বিকোচ্ছে না। উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজা যে কাজ করছে না সেটা মানছে সঙ্ঘ পরিবারও।
বাংলার কথাই ধরা যাক। ২০১১ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি-মানুষের সরকার চলছে। ২০১৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন পাওয়ার পর এ রাজ্যে তো বটেই, দিল্লির বিজেপির কর্তাব্যক্তিদেরও মাথা ঘুরে যায়। ২০২১ সালে তারা রাজ্যপাটে আসার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ভোট প্রচারে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ বস্তুত ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের ‘অপারেশন’ ব্যর্থ করে দেন মমতা। বিজেপির রথ বিধানসভার ৭৭টি আসনেই আটকে যায়। তারপর ২০২২ সালে পুরসভা, ২০২৩ পঞ্চায়েত এবং ২০২৪ সালে লোকসভার নির্বাচনে কেবল বিজেপি নয়, সিপিএম-কংগ্রেসকে জোড়াফুল খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়েছে। সেই ভোটের পর দু’দফায় ১০টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। সেখানেও মমতারা দশে দশ। বিরোধীদের অবক্ষয়ের ছবি স্পষ্ট। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিজেপির দখলে থাকা মাদারিহাটেও এই প্রথম জোড়াফুল ফুটেছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিজেপির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে এ রাজ্যে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখে চলছে। এই রেকর্ড ‘ইন্ডিয়া’ জোটের তথাকথিত বড় শরিক কংগ্রেসেরও নেই। দীর্ঘদিন দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনা এবং বিজেপির যাবতীয় ‘হামলা’ মোকাবিলা করে মমতা সাফল্যের শিখরে বিরাজ করছেন। কিন্তু যোগ্যতার প্রশ্নেও দেশের মানুষের সামনে তাঁর বিকল্প এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই। তাই সময়ের ডাক হচ্ছে, মমতাকেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেত্রী করা হোক। নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির সঙ্গে সমানে টক্কর নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র তৃণমূল নেত্রীরই আছে।