চিনের প্রতারণা চক্রে ২০০০  কোটি টাকার বেশি উধাও

প্রতীকী চিত্র

মোবাইল ফোনে আকর্ষণীয় মোড়কে ঋণের হাতছানি নতুন কোনও ঘটনা নয়। কম সুদে বেশি টাকা পাওয়ার আশায় এই হাতছানি এড়াতে পারেন না অনেকেই। আর এর হাত ধরেই সর্বনাশের ফাঁদে পা রাখেন অনেক সচেতন, সতর্ক, বুদ্ধিমান মানুষও। অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ টাকা। এই উধাও হয়ে যাওয়া বিশাল অঙ্কের অর্থের হদিশ পেতে দীর্ঘদিন ধরেই তদন্ত চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা। এই প্রতারণা চক্রের হদিশ পেতে হাতে আসছে অনেক নতুন তথ্য। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এই চক্রের উৎস লুকিয়ে রয়েছে চিনে। তথ্যানুসারে, গত বছর ডিজিটাল অ্যারেস্ট প্রতারণার মাধ্যমে ১২০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। গত এক বছরে প্রতারণার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি।

বিভিন্ন প্রতারণা মামলায় নাইজেরিয়ান ফ্রড বা জামতারা গ্যাং-এর সঙ্গে যুক্ত অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।  চলতি বছরেই দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন নাইজেরিয়ান।  অনলাইন প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে নাগপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও  এক নাইজেরিয়ানকে। নাইজেরিয়ান ফ্রডের মতোই দেশে কুখ্যাত জামতারা গ্যাং। অ্যাকাউন্ট শূন্য করে দিতে জামতারা গ্যাংয়ের জুড়ি মেলা ভার। জামতারার পর উঠে এসেছে ভরতপুরের নামও।    তবে এই সব গ্যাং-ই এখন অতীত। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, বর্তমানে দেশে ঘটে চলা সাইবার অপরাধের মূল চাবিকাঠি রয়েছে চিনের  নিয়ন্ত্রণে।

ঘটনার সূত্রপাত কলকাতার কাশিপুরে। ২০২৩-এর মে মাসে কাশিপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন শেখর পাল নাম এক ব্যক্তি। অভিযোগে তিনি জানান, ইন্টারনেটে একটি গেমিং অ্যাপ-এর দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তিনি গেম খেলতে শুরু করেন। প্রথমে কিছু টাকা গেম-এ লগ্নি করে ধীরে ধীরে জিততে শুরু করেন বিপুল অঙ্কের টাকা। আরও বেশি লাভের আশায় বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে শুরু করেন ওই ব্যক্তি। জেতার গাড়িও এগিয়ে চলে গড়গড়িয়ে। গেমিং অ্যাপের অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণও বাড়তে থাকে। ১৩ লক্ষেরও বেশি টাকা জমে যায় ওই ব্যক্তির গেমিং অ্যাকাউন্টে। গেমিং অ্যাপের খেলা শেষে এবার শুরু হয় আসন খেলা। দেখা যায় ওই বিপুল পরিমান অঙ্কের টাকা কোনও ভাবেই তাঁর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা যাচ্ছে না। এরপরই তিনি আবিষ্কার করেন ওই অ্যাপটি অফলাইন হয়ে গিয়েছে। ততদিনে তাঁর ক্ষতির পরিমান ২১ লক্ষ টাকা। এরপরই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন ওই ব্যক্তি।
২০২৩-এর ১৬ মে কাশিপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।


তদন্তের সূত্র ধরে ইডি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। ধৃতদের একজন ছিলেন চেন্নাইয়ের বাসিন্দা, নাম জোসেফ স্ট্যালিন। এছাড়াও ছিলেন বিহারের চেতন প্রকাশ, ওড়িশার আলোক কুমার সাহু ও অরুন কুমার সাহু। জড়িতদের জেরা করে উঠে আসে তিনটি সংস্থার নাম। তদন্তে দেখা যায়, ওই তিন সংস্থার মাধ্যমে প্রতারণার টাকা পাচার করা হতো। তদন্ত আরও এগোলে দেখা যায় চেন্নাইয়ের সংস্থা যার ডিরেক্টর জোসেফ স্ট্যালিন, এবং অপর ডিরেক্টর চিনা নাগরিক পেই পেনজুইন। তদন্তের অগ্রগতির সঙ্গে মেলে  তিন চিনা নাগরিকের হদিশ, এঁরা হলেন জং লংলং , জাং ওয়েনজিন, হুয়াং লিয়াংলিয়াং। তিনজনের ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট মেলে ২৪ কোটি টাকা। তদন্তে জানা যায়, এই চিনা নাগরিকরা কখনোই ভারতে আসেননি, বা তাঁদের সঙ্গে ভারতের কোনও যোগাযোগও নেই।

গোয়েন্দাসূত্রে খবর, জোসেফ স্ট্যালিন বা চেতন প্রকাশ ভারতে এজেন্টের কাজ করে, এবং তাদের হাত ধরেই চিনের ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যায় কোটি কোটি টাকা।  তথ্যানুসারে, গত বছর ডিজিটাল অ্যারেস্ট প্রতারণার মাধ্যমে ১২০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। গত এক বছরে প্রতারণার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি।

গেমিং অ্যাপের মধ্যে দিয়ে এই ভাবেই ভারতের বাজারে ঢুকে পড়েছে চিন নিয়ন্ত্রিত সাইবার জালিয়াতি। পাশাপাশি রয়েছে, ঋণ প্রতারণা, ডিজিটাল অ্যারেস্ট প্রতারণা, সাম্প্রতিকতম সংযোজন হল স্টক মার্কেটে জাল বিনিয়োগ।  এই সমস্ত প্রতারণার নেপথ্যেই রয়েছে চিনের  মাফিয়া চক্র।  এই মাফিয়া চক্র চিন সরকারের কাছ থেকেও পরোক্ষভাবে সাহায্য পায় বলে গোয়েন্দাদের অভিযোগ।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, প্রতিটিদিন অহরহ আমরা ফোনে যে অ্যাপ ব্যবহার করে থাকি তার বেশিরভাগই চিনের। ফলে খুব সহজেই চিনের সার্ভারে ভারতীয়দের তথ্য চলে যাচ্ছে। নিজেদের অজ্ঞানতার কারণেই নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য তুলে দেওয়া হচ্ছে চিনের হাতে। চিনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ২০০৭-এ গড়ে তোলা হয় স্পেশাল ইকোনমিক জোন।  ভারতীয় গোয়েন্দাদের অনুমান , এই জোন থেকেই ভারতের মতো দেশে সাইবার প্রতারণা চালানো হয়ে থাকে।

সম্প্রতি এনআইএ তদন্তে উঠে এসেছে, একদিকে ভারতীয় এজেন্টদের মাধ্যমে প্রতারণা, অন্যদিকে এই ভারতীয় এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে শিক্ষিত যুবকদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিনের স্পেশাল ইকোনমিক জোনে। সেখানে তাঁদের কার্যত বন্দি করে রেখে প্রতারণা করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।

সম্প্রতি ডিজিটাল অ্যারেস্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনটি পদক্ষেপের কোথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।  তাঁর পরামর্শ, তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নয়, ভাবুন, স্ক্রিনশট নিন, এবং রেকর্ড করুন। তারপর পদক্ষেপ করুন। প্রয়োজনে ন্যাশনাল সাইবার হেল্পলাইনে ১৯৩০ ডায়াল করে রিপোর্ট করুন, পুলিশকে জানান।  সমস্ত প্রমাণ রাখুন, তবেই আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তা বজায় থাকবে।

……………………………………………
ডিজিটাল প্রতারণার সরকারি তথ্য
……………………………………..
এক বছর আগে প্রতি মাসে দেশে গড়ে প্রতারণার শিকার -২ লক্ষ মানুষ (টাকার অঙ্ক- ২৫০ কোটি -৩০০ কোটি )
বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে প্রতারণার শিকার – ২.৫০ লক্ষ মানুষ ( টাকার অঙ্ক পেরোচ্ছে ৫০০ কোটির ঘর )

এক নজরে ২০২৪ –

প্রতারিত ——- প্রতারণার অঙ্ক

জানুয়ারি –      ২.৬৯ লক্ষ —– ৪৩৫ কোটি
ফেব্রুয়ারি –     ২.৫৭ লক্ষ —– ৫০৭ কোটি
মার্চ –             ২.৫৭ লক্ষ —– ৪৭১ কোটি
এপ্রিল –           ২.৩৮ লক্ষ —– ৪১৪ কোটি
মে –              ২.৮১ লক্ষ —– ৫৪৫ কোটি
জুন –             ২.৩৬ লক্ষ —– ৪৮০ কোটি
জুলাই –           ২.৫৪ লক্ষ —– ৪৬২ কোটি
আগস্ট –         ২.৩৪ লক্ষ —– ৪০১ কোটি