• facebook
  • twitter
Thursday, 16 January, 2025

মহাকুম্ভ ২০২৫-এর প্রথম রাজসিক মহাস্নান পর্বের প্রাক মুহূর্তে

পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের সন্তান। শেক্সপিয়ার, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বেশ ভালোই পড়েছেন। তাঁর বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের বেশি নয় বলেই মনে হলো।

ছবি: দ্য স্টেটসম্যান

অরুণকুমার রায়, এলাহাবাদ 

তখনও মহাকুম্ভের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। আর কয়েকদিন পরেই ১৩ জানুয়ারি। এই দিন থেকেই মহাকুম্ভ ২০২৫-এর প্রথম রাজসিক পুণ্যস্নান পর্ব শুরু হবে। মকর সংক্রান্তি, ১৪ই জানুয়ারি মঙ্গলবার। আগামী ২৬ শে ফেব্রুয়ারি অবধি ত্রিবেণী সঙ্গমের বালুতটে দিব্য, ভব্য এবং অলৌকিক সংসার জীবন্ত হয়ে উঠবে। প্রায় ১৬ কিমি পরিধিতে ছড়ানো এই মেলা বিশ্বের সর্বোচ্চ ধার্মিক মহামেলা হয়ে উঠতে চলেছে। ত্রিবেণী বালুতটে এই মেলা প্রায় ৪৫ দিন অবধি থাকবে।

প্রয়াগ মহাকুম্ভের প্রস্তুতি শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। আর মাত্র দুই দিন পরেই মহাকুম্ভের প্রথম ‘রাজসিক স্নান’। সমস্ত আখড়াগুলির প্রস্তুতি চরমে পৌঁছেছে। এবার তিনদিন ধরে বিভিন্ন আখড়া তাদের প্রতীকী চিহ্ন, তাদের দেবতা সহ শহর পরিক্রমা করে কুম্ভ অঞ্চলে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন আখড়ার কুম্ভ অঞ্চলে প্রবেশ করা তৎসহ নগর পরিক্রমার দৃশ্য খুবই অসাধারণ।

জ্যোতিষবিদদের মত অনুযায়ী, এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত সমাপতনই বলা যায়। সেই অনুসারে ১৪৪ বছর পরে মহাযোগ ‘মহাকুম্ভ ২০২৫’। সুতরাং এই দিব্য ও ভব্য আয়োজনে সমস্ত আখড়াগুলি এই তিথি ও তাঁদের আখড়ার ঐতিহ্য অনুসারে মেলায় সামিল হতে চলেছে।

প্রয়াগ মহাকুম্ভ ২০২৫-এর প্রস্তুতির মধ্যেই গতকাল আহ্বান আখড়া বৈভব পূর্ণ ভাবে নগর পরিক্রমা করলেন। তাঁদের এই নগর পরিক্রমার সময় তাঁরা ঢোল, নাগাড়া ও গানবাজনা সহ নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আহবান আখড়ার সাধু সন্ত ঘোড়ায় এবং পালকিতে সওয়ার হয়ে প্রয়াগ নগরীর বিভিন্ন পথ ঘুরে কুম্ভ অঞ্চলে তাঁদের অস্থায়ী শিবিরে প্রবেশ করলেন। সেসময় সাধু সন্তদের মুখে ছিল ঈশ্বরের নাম গান। তাঁরা তাঁদের পূজা অর্চনার মুহূর্তে মহা কুম্ভের সফলতা ও নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হওয়ার কামনা করেন। তাঁদের এই যাত্রাপথে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। বড় উদাসীন আখড়া, নয়া উদাসীন আখড়া এবং জুনা আখড়ার সাধু-সন্তদের নগর প্রবেশ হয়েছে।

তপোনিধি আনন্দ আখড়া তাদের পরম্পরা অনুযায়ী কুম্ভ অঞ্চলে প্রবেশ করলেন। সেই দৃশ্য অভাবনীয়। নাগা সন্ন্যাসীদের ভব্য শোভা যাত্রায় সামিল ছিল হাতি, ঘোড়া ও রথ। মেলা প্রশাসন এবং নগরবাসীগণ সন্ন্যাসীদের পরস্পর মাল্য অর্পণ এবং সম্মিলিত সন্ন্যাসীবৃন্দের উপর পুষ্প বর্ষা করেন। সাধু-সন্ত এবং সন্ন্যাসীবৃন্দ ধর্মধ্বজা তুলে ধরেন, তাঁদের শিবিরে সূর্য দেবতার মন্দির স্থাপনা করেন।

বিভিন্ন আখড়ার নগর প্রবেশের মহত্ত্ব
বিভিন্ন আখড়ার ‘নগর প্রবেশ’-এর তাৎপর্য হলো, যখন সাধু-সন্তগণ কোনো শুভ মুহূর্তে নগরে এসে অবস্থান করেন। এরপরেই কুম্ভ মেলার গতিবিধি শুরু হয়। মহাকুম্ভের প্রথম মহাস্নান পৌষ পূর্ণিমা স্নান থেকে শুরু হয় এবং এই পর্বের সমাপন হয় মহা শিবরাত্রির দিন ২৬ শে ফেব্রুয়ারি।

প্রয়াগের পবিত্র ত্রিবেণী সঙ্গমে আয়োজিত এই মহাকুম্ভ কেবলমাত্র ধার্মিক আয়োজনই নয়, একাধারে এই মহাকুম্ভে দেখা যাবে আধ্যাত্মিক, সঙ্গীত এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য মিশ্রণ। এই মহাকুম্ভে যেই মুহুর্তে কোটি কোটি পুণ্যার্থী ত্রিবেণী সঙ্গমের জলে ডুব দিয়ে পুণ্য অর্জন করবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে গঙ্গার বালু তটে ভক্তি ও সঙ্গীতের এমন দিব্য আয়োজন করা হয়েছে, যা সকলের হৃদয় স্পর্শ করে যাবে।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, মহাকুম্ভ উপলক্ষে বলিউড এবং ভারতীয় টেলিভিশন জগতের বহু নামী-দামী তারকারা আসছেন। শতাব্দীর মহানায়ক অমিতাভ বচ্চন, আলিয়া ভাট, রণবীর কাপুর ও রাখী সাওয়ান্তের মতন তারকারা এই মহাকুম্ভের আয়োজনের পুণ্যের অংশীদার হবেন। এই সমস্ত তারকাদের থাকার জন্য অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত শিবির তৈরি করা হয়েছে। টিভি ও দক্ষিণী সিনেমার বহু তারকারাও মহাকুম্ভের সময়ে আসবেন।

এইবার মহাকুম্ভে বিশেষ সঙ্গীতময় সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে ভক্তি সঙ্গীতের বিখ্যাত শিল্পীরা পুণ্যার্থীদের স্বীয় সঙ্গীতের মায়াজালে মন্ত্রমুগ্ধ করবেন। মহাকুম্ভে স্থিত ‘গঙ্গামণ্ডপে’ আয়োজিত এই রকম অনুষ্ঠানগুলিতে শঙ্কর মহাদেবন, মালিনী অবস্থী, কৈলাশ খের, সোনু নিগম, মৈথিলী ঠাকুর, কবিতা পৌডওয়াল, জুবিন নৌটিয়াল তথা শ্রেয়া ঘোষালের মতন বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁদের সঙ্গীতের সুর মূর্ছনা ছড়িয়ে দেবেন দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে।

কুম্ভ অঞ্চল ঘুরে প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা
গত কয়েকদিন ধরে সকালে ১০টার সময়েই বেরিয়ে পড়ছি কুম্ভ নগরীর উদ্দেশ্যে। প্রায় তিরিশ কিমি বা তার একটু বেশি বৈ তো কম নয়। কেবল হাঁটছি তো হাঁটছি। গত কয়েকদিন থেকে সমস্ত সাধু সন্তদের আখড়াগুলি শোভাযাত্রার মাধ্যমে কুম্ভ নগরীতে তাদের শিবিরে প্রবেশ করছেন। সঙ্গে চলেছে তাঁদের ইষ্ট দেবতা ও লক্ষ লক্ষ ভক্ত। যার জন্য শহরে প্রবল যান জট সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এটি সাময়িক যা দুই একদিনের মধ্যে সাধু সন্ন্যাসীরা কুম্ভ অঞ্চলে প্রবেশ করলেই মিটে যাবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

পুলিশ প্রশাসন যার মধ্যে দুর্ধর্ষ ঘোড় পুলিশ সহ বিশাল পুলিশবাহিনী শশব্যস্ত সাধু সন্তদের নিয়ে। ব্যান্ড, বাদ্য, ড্রাম-বিউগল, শিঙ্গা আর নানান কসরত দেখাতে দেখাতে তাঁরা চলেছেন পথ দিয়ে। হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে এক ঘোড়সওয়ার সন্ন্যাসীর মুখ দেখে যেন অবিকল আনন্দমঠের মহেন্দ্রের মুখটিই মনে পড়ে যাচ্ছে।‌ শহর এখন কুম্ভময়। কুম্ভ জ্বরে আক্রান্ত। শীতের পারদ ছয় থেকে নয়ের মধ্যে ওঠা নামা করছে প্রয়াগ শহরে।

আজ কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে গেল এবং পরিচয় হলো বাঙালি নাগা সন্ন্যাসী ও কিন্নর আখড়ার একজন অপরূপা সুন্দরী তেজস্বিনী বাঙালি সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে। সন্ন্যাসিনীকে ‘অপরূপা সুন্দরী’ বললে পাপ হবে না তো! তাই যদি হয়, তবে সত্য বলাতেও পুণ্য সঞ্চয়। হ্যাঁ অসাধারণ পরমা সুন্দরী তিনি।

” অত হে মহাদেবী, নিত্য রক্ষা সনাতনী “। নাগা সন্ন্যাসীদের বীজ মন্ত্র কি এটা !

মহাকুম্ভ প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে কোথায় পৌঁছেছে! বেশ কিছু খামতি নজরে এসেছে বৈকি। রামকৃষ্ণ মিশন ১০০০ ভক্তদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প করছে। কুম্ভ নগরীতে জায়গা পেতে বহু বিলম্ব হয়েছে। তেমনই বৈদ্যুতিক কানেকশান পেতেও। তাই নাজেহাল অবস্থা এলাহাবাদ মঠ মিশনের প্রধান কার্তিক মহারাজের। নিজেই কুম্ভমেলায় গিয়ে বসে আছেন। সব তদারকী করছেন। তিনি এবং মঠের সন্ন্যাসী তথা ভক্তবৃন্দদের বিশ্বাস ঠাকুর, মা সব ঠিক করে দেবেন। হলও তাই, রামকৃষ্ণ মিশন অস্থায়ী ক্যাম্প উদ্বোধন হয়ে গেল আজ সকাল এগারোটায়। ঠাকুর, মা এবং স্বামীজীর ফটো প্রতিকৃতিকে সামনে রেখে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামীজী ত্রিবেণী সঙ্গমে এসেছিলেন।

কুম্ভ নগরীর অন্যতম প্রবেশ পথে যেতে গিয়ে নজরে পড়লো পথের দুধারে বৃক্ষরোপণ করে তার চতুর্দিকে সুন্দরভাবে ঘিরে তাতে সুন্দর সুন্দর হিন্দিতে বাণী লেখা হয়েছে। যার ভাবার্থ হল– ‘আপনি স্বয়ং নিজেকে ভালো করে তৈরি করুন, দুনিয়া থেকে একটি খারাপ মানুষ কম হয়ে যাবে।’

‘বোধশক্তির গভীরতা জীবনকে শান্ত বা মৌনতার দিকে নিয়ে যায়।’ ‘ঈশ্বর কর্ম দেখেন, ধন সঞ্চয়পত্র নয়’

সনাতন ঐতিহ্যের বহমান জলধারা ছল ছল করে বয়ে চলছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে। আজকের ভারতবর্ষে রাজনীতি ও ধর্মনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকলেও গঙ্গার কিনারে কোনো রাজনীতির বিন্দু বিসর্গ নেই। যা আছে তা হলো আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ সর্বত্র।

নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ধুবুলিয়া থেকে ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কার্তিক দাস এই মুহূর্তে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ত্রিশূল মহারাজকে। তাঁর কাছে আশ্রয় পেলে আর তিনি ফিরে যাবেন না। কিন্তু কে এই ত্রিশূল মহারাজ! জানতে চাইলে, অনতি দূরে তিনি ল্যামপোস্টে টাঙ্গানো ত্রিশূল মহারাজের ফ্লেক্সের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

নদীয়া জেলারই পায়রাডাঙ্গা থেকে উচ্চ শিক্ষিত দেবাশীষ কুণ্ডু এসেছেন নাগা সম্প্রদায় ভুক্ত হবেন বলে। আমি জিজ্ঞাস করলাম, ‘আপনি কি সম্পুর্ণ নাঙ্গা হয়ে যাবেন!’ তিনি বললেন,’না, নাগা হওয়া খুব কঠিন ও সাধনা লব্ধ। তিনি কণ্ঠি নিয়েছেন।’

জুনা আখড়ার বাঙালি নাগা সন্ন্যাসী থানাপতি মোহন্ত নিত্যানন্দ গিরি মহারাজের সঙ্গেও পরিচয় হলো। সময় করে তিনি আমাকে নাগা সন্ন্যাসীদের স্থাপনার ইতিহাস ও জীবন রহস্য জানাবেন। তিনি বলেন, ‘নিজের সাধ করে যাকে নিয়ে আসা যায় তাকে সাধনা বলে।’ কঠিন কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমেই নাগা সন্ন্যাসী হওয়া যায়। মদ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন সম্পূর্ণ নিষেধ। কেবল গঞ্জিকা ও ডাবের জল তাঁর আহার। তাঁর মুখ মন্ডল বাঙালিয়ানায় ভরপুর।পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের সন্তান। শেক্সপিয়ার, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বেশ ভালোই পড়েছেন। তাঁর বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের বেশি নয় বলেই মনে হলো। আমাকে মধ্যাহ্নের আহার করে যেতে বললেন। তিনি একদিন মঠের প্রধান অধিপতির সঙ্গেও পরিচয় করাবেন বললেন। তিনিও বাঙালি। কালীঘাটের পটুয়াপাড়ায় তাঁদের আশ্রম। এখন কিন্তু তাঁরা নাগা বেশে কেউই নেই। রাজসিক মহাস্নানের দিন তাঁরা সম্পূর্ণ নাগা বেশে ত্রিবেণী সঙ্গমের জলে অবগাহন করবেন।

প্রসঙ্গত মহাকুম্ভের সর্বত্র বাঙালিদের ভিড় চোখে পড়ার মতন। কুম্ভ মেলার প্রধান প্রবেশ পথে আদিগুরু শঙ্করাচার্য মহাস্নানে আগত পুণ্যার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছেন। কুম্ভ অঞ্চলে সর্বত্র হিন্দি লেখা থাকলেও বেশ কয়েকটি স্থানে বাংলায় লেখা ফলক দিশা দেখাচ্ছে। কিন্তু উর্দু ও ফারসি ভাষা কুম্ভমেলায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

প্রয়াগ মহাকুম্ভ সারা বিশ্বের সামনে ভারতবর্ষকে তুলে ধরেছে। তার আদর্শ “বসুধৈব কুটুম্বকম” মহাকুম্ভে বিশ্বের বহু মান্যগণ্যদের আগমন হতে চলেছে। যার মধ্যে অন্যতম অ্যাপেল কোম্পানির প্রধান স্টিভ জবসের সহধর্মিণী লরেল পাওয়েল জবস্‌।