নিশানাতে মংপু, কবিগুরুর সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা

শম্পা চৌধুরী
গ্রীষ্মকালে পাহাডে়র আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন, তাই চৈত্রের শেষে  প্রিয় শৈলশহর দার্জিলিং রওনা হলাম, তবে দার্জিলিং এখন কোলাহল মুখর অধিক জনসমাবেশে পরিপূর্ণ৷ যেটা সবচেয়ে আঘাত করলো শহরে ব্যবহূত প্লাস্টিক-আবর্জনা সেগুলোকে পাহাডে়র খাদে পাইন বনের মধ্যে ডাম্প করা হচ্ছে,
ফলস্বরূপ জলনিকাশি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পাইন বনের ধংসের কারণ হবে কিছু বছর বাদে৷ দু’দিন দার্জিলিঙে কাটিয়ে আমরা মংপু হয়ে সিটং রওনা হলাম, মংপুর নিকট আসতেই কুয়াশা মিশ্রিত সবুজ পাহাড় আর নিজে থেকেই জন্মান বিভিন্ন পাহাড়ি ফুল ও অর্কিডে মায়াবী রূপ ধারণ করলো প্রকৃতি৷
মংপু যাবার প্রধান আকর্ষণ রবীন্দ্রভবন দর্শন, প্রথম প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে ট্রি হাউস দেখে আমারা ভেতরে ঢোকার জন্য টিকিট কাউন্টারে গেলাম সেখানে এক নেপালি ভদ্রমহিলা পরিস্কার বাংলাতে কথা বলছেন, বাংলা ভাষার মিষ্ঠত্ব যেন নতুন করে অনুভব করলাম৷
মূল দরজার সামনেই গুরুদেবের বড়ো একটা ছবি তাতে রজনীগন্ধার মালা , ধূপের গন্ধ তার সাথে রবীন্দ্রসংগীত  “মাঝেমাঝে তব দেখা পাই”….সে এক মনোমুগ্ধকর শান্ত পরিবেশ, গুরুদেবের ছবির সামনে প্রণাম করলাম, গৃহের যেকোন স্থান থেকে দেখলেই মনে হয় তিনি আমাকেই দেখছেন৷
৩৭৬০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজডি়ত রবীন্দ্রভবন প্রথমে সিঙ্কোনা মন্ত্রকের বাংলো ছিল, বিখ্যাত কুইনোলজিস্ট ড: মনমোহন সেন এই অঞ্চলে সিঙ্কোনা গাছের প্রাচুর্য দেখে তার বানিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই এখানে সিঙ্কোনা চাষের সুব্যবস্থা করেন৷ তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত সাহিত্যিক মৈয়েত্রী দেবীর (১৯৭৬ সালে ন হণ্যতে উপন্যাসের জন্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান) আমন্ত্রণে গুরুদেব প্রথম ১৯৩৮ সালের ৫ই জুন মংপু যান৷
এখানকার পাহাডে়র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করে, চারদিন থেকে ৯ই জুন কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন৷ দ্বিতীয়বার ১৯৩৯ সালের ১৪ই মে পুরী থেকে গুরুদেব মংপু যান, সেখানে থেকে ১৭ই জুন কলকাতায় ফেরেন৷ মংপুতে থাকাকালীন গুরুদেবের ছোটখাট কথোপকথন, উপদেশ, ঘটনা মৈয়েত্রী দেবী লিপিবদ্ধ করতেন, সেই সকল স্মৃতিচারণ  ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আমারা পেয়েছি, যার ইংরাজী অনুবাদও মৈয়েত্রী দেবী নিজে করেছিলেন ‘Tagore by Fireside ,is equally brilliant ’
তৃতীয়বার কবি ১৯৩৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর যান, এবার দু’মাস থেকে কলকাতায় ফেরেন৷ সেখানে থাকাকালীন গুরুদেব লেখার ডেস্ক ও চেয়ার নিজে নক্সা এঁকে মেহগনি কাঠের তৈরী করান, জানালার ধারে কুশান সমেত চেয়ারটি এখন রাখা রয়েছে, যেখানে বসে বিশ্বকবি ক্যামেলিয়া, সানাই, আকাশ প্রদীপ রচনা করেন, পেন্টিং করার ত্রিভুজ আকৃতির লম্বা স্ট্যান্ড, রঙের ট্রে, ব্রাশ সুন্দর করে সাজান রয়েছে, এগুলো ব্যবহার করে গুরুদেব অনেক পাহাডে়র ছবি, পোট্রেট, কল্পচিত্র এঁকেছেন৷ রবীন্দ্রভবনের সমগ্র  দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিশ্বকবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, পারিবারিক ছবি, বিদেশযাত্রা এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের কাটিং সুন্দর করে বাঁধিয়ে রাখা, কবির নিজহাতের ডুডুল আমাদের অমূল্য সম্পদ৷
বাংলোর পূর্বদিকের ঘরটি ছিল গুরুদেবের শোওয়ার, সেখান থেকে সূর্য উদয় দেখা যেত, এই ঘরের জানালার ধারের বড় গাছের কথা তাঁর ‘নবজাতক’ কবিতায় উল্লেখ করা আছে৷ পালিশ করা কাঠের মেঝে, ফায়ার প্লেস, কাঠের সিন্দুক, খাট সবকিছুই বিদ্যমান৷ এখানে স্নানঘরে বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল, ছোট প্রকোষ্ঠে ঠান্ডা জল এবং মাঝারি প্রকোষ্ঠে গরম জল ঢালা হতো, বড়ো প্রকোষ্ঠে মিশ্র জল জমা হতো গুরুদেব তার মধ্যে বসে স্নান করতেন৷
চতুর্থবার, ১৯৪০ সালের ২১ শে এপ্রিল গুরুদেব মংপু যান, সেই বছর ২৫শে বৈশাখ তাঁর জন্মদিন মংপুতে পালন করা হয়৷ সেই সময়ে শান্তিনিকেতনে জলের অভাব থাকায় ১লা বৈশাখ গুরুদেবের জন্মদিন পালন করে গ্রীষ্মকালীন ছুটির ঘোষণা করা হতো|
বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির  আদান-প্রদান এবং মূল্যবোধের প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য শান্তিনিকেতন, দীন দরিদ্র মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতেই শ্রীনিকেতন, গুরুদেবের এই মহৎ চিন্তাভাবনার উল্লেখ মংপুতে লেখা আছে৷
১৯৪০সালের মে মাসে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের সময় গুরুদেবের খুব ইচ্ছা ছিল শরৎকালে আবার মংপু যাবার, সেই মতোই নিজের ব্যবহূত জিনিস মংপুতে রেখে এসেছিলেন কিন্ত সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কালিম্পং পৌঁছে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পডে়ন,২৮ শে সেপ্টেম্বর তাঁকে চিকিৎসার জন্য অজ্ঞান অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে আসা হয়….
শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখতে আমাদের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, বেরিয়ে আসার সময় গুরুদেবের ছবির ওপর আবার দৃষ্টি পড়লো, হটাৎ মনে পড়লো আজ তো ১লা বৈশাখ! তাই গুরুদেব, প্রিয় রজনীগন্ধায় সজ্জিত হয়েছেন৷
একটাই আক্ষেপ থেকে গেল এখানকার কেয়ার টেকার শিশিরজীর সাথে দেখা হলো না, এই নেপালি ভদ্রলোকের গলায় রবীন্দ্র সংগীত শোনার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত রইলাম৷
যে কথা না বললে লেখাটি অপূর্ণ থেকে যায় তাহলো সিটং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ,অসাধারণ এক স্বর্গীয় শান্ত পরিবেশ৷ আমরা যেদিন পৌঁছলাম সেইদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামলো, বৃষ্টির সাথে বজ্রবিদু্যৎ এর রেখাগুলোকে মনে হচ্ছিল পাহাড় যেন হীরের নেকলেস পডে়ছে, সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো, কত রকমের পাখির সমাহার,তার মাঝে ঝুঙকীরা (স্থানীয় ভাষায় বলে, এটা একটা পাইন গাছের পোকা) থেকে  থেকে ডেকে চলেছে, রোদ ঝলমলে একটা সকাল, খুব অল্প সময়ের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পেলাম, চিরস্মরনীয় হয়ে থাকলো সে দৃশ্য, কিন্ত বাস্তব যে বড়োই কঠিন, এবার ফিরতে হবে, অহলদারা ও নামখিনপোখরি দেখে আমরা কলকাতার ট্রেন  ধর