নীরবতা ভেঙে মোদিকে আক্রমণ করে খোলা চিঠি মনমোহন সিংয়ের 

দিল্লি, ৩০ মে – লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে  সমালোচনায় বিদ্ধ করলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বৃহস্পতিবার প্রচারের শেষ দিন। আর বৃহস্পতিবারই দেশবাসীর উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখে সরব হলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। পাঞ্জাবের জনগণের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘বিগত দশ বছরে বিজেপি সরকার পাঞ্জাব, পাঞ্জাবি এবং পাঞ্জাবের সংস্কৃতির নিন্দা করতে আর কিছু বাকি রাখেননি।’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের তীব্র সমালোচনা করে তিনি লেখেন, ‘অতীতে কোন প্রধানমন্ত্রীই সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশ বা বিরোধীদের নিশানা করতে “বিদ্বেষপূর্ণ ও  অসংসদীয়” ভাষা ব্যবহার করেননি।   

দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা তিন পৃষ্ঠার খোলা চিঠিতে বৃহস্পতিবার মনমোহন বলেন, এবারের ভোট প্রচার খুব ভালোভাবে দেখছিলাম। মোদিজি সারাক্ষণ ঘৃণাভাষণ দিয়ে গিয়েছেন, যা অত্যন্ত বিভাজনমূলক রাজনীতি। মোদিজি হলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ওই পদের মর্যাদাকে নিচে  নামিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পদের মর্যাদার গুরুত্ব ক্ষুণ্ণ করেছেন। দেশের আর কোনও প্রধানমন্ত্রী এতটা হীন ছিলেন না। মনমোহন আরও লিখেছেন, ওনার ভাষণের আদ্যোপান্ত ভাষা ছিল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অথবা বিরোধীদের নিশানা করে। ওরা আমার সম্পর্কেও ভুল বলেছে। মনমোহন লিখেছেন, আমি জীবনে কোনওদিন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্যদের আলাদা করে দেখিনি। এটা বিজেপির বিশেষ অধিকার এবং এতেই ওরা অভ্যস্ত।শনিবার অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পাঞ্জাবেও ভোট। দেশবাসীর উদ্দেশে চিঠি লিখলেও মূলত পাঞ্জাবিদের উদ্দেশেই বার্তা দিতে চেয়েছেন মনমোহন সিং।

তিন পৃষ্ঠার এই খোলা চিঠিতে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা গত এক দশকে মোদি শাসনের বিভিন্ন দিকের সমালোচনা করেছেন। অর্থনীতির পাশাপাশি কৃষক আন্দোলন, আয় বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব, ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়েই মতামত ব্যক্ত করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে, লোকসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বের ভোট গ্রহণের আগে তাঁর আবেদন, “স্বৈরাচারী শাসনের আক্রমণ থেকে, আমাদের গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে সুরক্ষিত করার জন্য চূড়ান্ত সুযোগের সর্বাধিক ব্যবহার করুন।”


মনমোহন এ-ও লিখেছেন, ‘‘তিনি আমার বিরুদ্ধেও অসত্য কথা বলেছেন। আমি কখনও কোনও সম্প্রদায়কে নিয়ে কোনও মন্তব্য করিনি। ওই বিষয়টিতে বিজেপির স্বত্ব নেওয়া রয়েছে।’’

রাজস্থানের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করেছিলেন, কংগ্রেস দেশের সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে পুনঃবন্টনের পরিকল্পনা করেছে। নিজের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি ইউপিএ সরকারের সময়, মনমোহন সিং-এর করা এক মন্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন। এদিনের চিঠিতে মনমোহন সিং সাফ জানিয়েছেন, “কোনোদিন কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদাভেদ করিনি।”

অর্থনীতি বিষয়ে মনমোহন সিং বলেছেন, “বিমুদ্রাকরণ বিপর্যয়, ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি এবং কোভিড মহামারীর সময়ের অব্যবস্থার ফলে একটি শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।  বিজেপি সরকারের আমলে গড় জিডিপি বৃদ্ধি ছয় শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছে। কংগ্রেস-ইউপিএ আমলে এটা ছিল প্রায় আট শতাংশ। বেকারত্ব এবং লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি সামাজিক বৈষম্যকে আরও  প্রসারিত করেছে।”

কৃষকদের বিক্ষোভের কথাও উল্লেখ করেছেন মনমোহন সিং। শেষ পর্যন্ত মোদি  সরকার তিনটি বিতর্কিত আইন ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেও, তার আগে কৃষকদের লাঞ্চনা করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন মনমোহন। তিনি লিখেছেন, “যেন লাঠি এবং রাবার বুলেট যথেষ্ট নয়, সংসদের অন্দরে প্রধানমন্ত্রী আমাদের কৃষকদের ‘পরজীবী’ বলে লাঞ্ছিত করেছেন। মোদিজি ২০২২ সালের মধ্যে আমাদের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, গত ১০ বছরে তাঁর নীতিগুলি কৃষকদের উপার্জন কমিয়েছে। কৃষকদের জাতীয় গড় মাসিক আয় দিন প্রতি ২৭ টাকা। যেখানে কৃষক প্রতি গড় ঋণ রয়েছে ২৭,০০০ টাকা।” ইউপিএ সরকার ৩.৭৩ কোটি কৃষকদের ৭২,০০০ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছিল, মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন, আজ কংগ্রেস এমএসপির জন্য একটি আইনি গ্যারান্টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

মনমোহনের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ৩০ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। কিন্ত ১০ বছরে মোদি  সরকার তা পূরণ করেনি। উল্টে সেনাবাহিনীতে অস্থায়ী নিয়োগ করেছে। যা থেকে বিজেপির জাতীয়তাবাদের মুখোশ খুলে গিয়েছে বলে খোলা চিঠিতে লিখেছেন মনমোহন। সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবের ভূমিকার ইতিহাসও স্মরণ করিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।

মোদি জমানায় সামগ্রিক ভাবে গৃহস্থের সঞ্চয় এবং আমজনতার ক্রয়ক্ষমতাও তলানিতে পৌঁছেছে বলে দাবি করেছেন মনমোহন। সার্বিক ভাবে এই ১০ বছরে সব দিক থেকেই ভারত নিম্নগামী হয়েছে বলে দাবি করেছেন মনমোহন। ভোটারদের উদ্দেশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘এই শেষ সুযোগ ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামোকে রক্ষা করার। সে কথা ভেবে আপনারা আপনাদের মত প্রদান করুন।’’

দেশের মানুষের কাছে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন মনমোহন। তাঁর আবেদন, দেশের উন্নতি ও প্রগতিশীল ভবিষ্যতের গ্যারান্টি একমাত্র কংগ্রেসেই দিতে পারে। সংবিধান অক্ষত রাখতে বদ্ধপরিকর কংগ্রেস। আমি দুহাত জড়ো করে দেশবাসীর কাছে আবেদন করছি, শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন। এই মুহূর্তে দেশের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য এই বিরোধকামী শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা।