মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে মহারাষ্ট্র , ঝাড়খন্ড, ছত্তিসগড় বা মধ্যপ্রদেশে মহিলাদের জন্য আর্থিক সহায়তার পথ অনুসরণ করা হয়েছে। ভোটকে ঘিরে দলীয় ইস্তেহারে বাংলার লক্ষ্মীর ভান্ডারের আদলে নানা প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করা হয়েছে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। মাত্র ৬ মাস আগে লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট উঠে দাঁড়াতে না পারলেও, ৬ মাস পরে সেখানেই অভাবনীয় জয় এসেছে। মহারাষ্ট্রে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। ভোট বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই অতিরিক্ত ভোট শাসক জোটের পক্ষেই গিয়েছে। রাঁচীতে হেমন্ত সোরেনের ফিরে আসার পিছনেও এই একই কারণ দায়ী বলে মনে করছেন তাঁরা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে মহিলাদের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস কাজ করেছে দুই রাজ্যেই। মাসের শেষে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ টাকা প্রমাণ করে দিয়েছে, লক্ষ্মীর ম্যাজিক অবশ্যম্ভাবী।
২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের মুখে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মহিলাদের আর্থিক সহায়তার জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছে বাংলা। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প দিয়ে এর যাত্রা শুরু। এই প্রকল্পের সাফল্য থেকেই মমতার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর জন্ম , যা একান্ত ভাবেই মমতার নিজস্ব ভাবনার ফসল। নামও দিয়েছিলেন মমতা নিজেই। তার পর আর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভোটের ময়দানে মমতার এই ম্যাজিক কাজ করেছে অব্যর্থভাবে। সদ্যসমাপ্ত ৬ টি উপনির্বাচনও তার প্রমাণ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সময়ে এই ধরণের প্রকল্পগুলিকে কটাক্ষ করেছিলেন। ‘রেউড়ি রাজনীতি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন তিনি। পরে সেই ‘রেউড়ি রাজনীতি’ র কটাক্ষ গিলতে হয়েছে নিজেকেই। তাঁর দল বিজেপিকেও সেই একই রাস্তায় হেঁটে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছতে হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের আশঙ্কা, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের সাফল্য দেখে মোদী সরকার সারা দেশের জন্য এই মডেলের ধাঁচে একটি ‘কেন্দ্রীয়’ প্রকল্প চালু করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভাবেই তারা দূরদর্শী মমতার এই সফল প্রকল্পের আদলে কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করে রাজনৈতিক জয় আনার চেষ্টা করতে পারে।
তবে প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, অন্যান্য রাজ্য সরকার যখন তাদের রাজ্যে শিল্প গড়ার জন্য ‘ইনসেনটিভ’ দিচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা দিতে পারছে না। কারণ, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের’ মতো বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ বেড়েই চলেছে । সম্প্রতি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের’ উপভোক্তার সংখ্যাও বাড়িয়েছেন মমতা। প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে অর্থের পরিমাণও বাড়ানো হবে। তখন পরিকাঠামো-সহ অন্য নানা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে আধিকারিকদের একাংশ মনে করেন মহিলাদের হাতে নগদ অর্থ আসায় বাজার শক্তিশালী হচ্ছে যা সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করছে। শিল্পস্থাপনের জন্যও এটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
লোকসভা ভোটের পরে মহারাষ্ট্রের একনাথ শিন্ডে সরকার চালু করে ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্প। ঘোষণা করা হয়, প্রতি মাসে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে দেড় হাজার টাকা করে দেবে সরকার। ভোটের আগে একসঙ্গে পাঁচ মাসের টাকা, অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন মহিলারা। আবার ঝাড়খণ্ডে হেমন্তের সরকার গত আগস্ট থেকে ‘মাইয়া সম্মান’ প্রকল্পে মাসে হাজার টাকা দিতে শুরু করে। সেই অঙ্ক । দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলছে, শুধুমাত্র ওই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে মহিলা-ভোটকে আয়ত্তে এনে ফেলেছিলেন দেবেন্দ্র ফড়ণবীস, একনাথ শিন্ডে, হেমন্ত সোরেনরা, যা মোট প্রাপ্ত ভোটের ১২-১৪ শতাংশ।
মধ্যপ্রদেশে একই ধাঁচে ‘লাডলি বহনা’ প্রকল্প চালু করেছিলেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। ফলও মিলেছিল হাতে হাতে। কর্নাটকেও কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে ‘গৃহলক্ষ্মী’ প্রকল্পে মহিলাদের মাসে দু’হাজার টাকা করে দেবে। ভোটে জিতে তা বাস্তবায়িতও করেছেন সিদ্দারামাইয়া, ডিকে শিবকুমারেরা। একই রকম ভাবে তেলেঙ্গানায় ‘মহালক্ষ্মী’ প্রকল্প ক্ষমতায় আনে কংগ্রেসকে ।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প নিয়ে কম বিতর্ক বইতে হয়নি মমতাকে। মহিলা ভোট কুড়োতে মমতা এই প্রকল্প করেছেন বলে ঝড় তোলে বিরোধীরা। কিন্তু নির্বাচিনী প্রচারে বিজেপি নিজেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। রাজ্যে গেরুয়া শিবির ক্ষমতায় এলে মহিলারা আগের চেয়ে বেশি টাকা পাবেন বলে ঘোষণাও করেছিলেন অমিত শাহ। সুতরাং বিভিন্ন রাজ্যে জয়ের নেপথ্যে যে কাজ করেছে মমতার লক্ষ্মীর ভান্ডারের ম্যাজিক তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।