কণ্ঠরোধে কথার মাঝেই মাইক বন্ধ, নীতি-বৈঠক থেকে ওয়াকআউট মমতার

অভিযোগ ওড়াল কেন্দ্র, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের ভিডিয়োর উপরে পিআইবি লিখল ‘বিভ্রান্তিকর’

দিল্লি, ২৭ জুলাই– তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম পুনাঙ্গ বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনার অভিযোগ উঠেছে আগেই৷ এবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান করার অভিযোগ৷ নীতি আয়োগের বৈঠক শুরুর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে ওয়াকআউট করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর নিজের বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে আসেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বেরিয়ে এসে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে পাঁচ মিনিটও বলতে দেওয়া হয়নি৷ মাইক বন্ধ করে আমাকে অপমান করা হয়েছে৷ এটা খুব অপমানজনক৷ আর কোনওদিন বৈঠকে যাব না৷’

মমতার পাশাপাশি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সাত মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক বয়কট করেন এদিন৷ যদিও তাদের অভিযোগ ছিল কেন্দ্রীয় বাজেটে বঞ্চনা৷


যদিও মমতার মাইক বন্ধের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্রের দাবি, জনমানসকে বিপথে চালিত করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নীতি আয়োগের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাইক বন্ধ করার দাবি সঠিক নয়৷ মধ্যাহ্নভোজের পর বক্তব্য রাখার কথা ছিল৷ কিন্ত্ত দিল্লি থেকে ফেরার তাড়া থাকায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে বৈঠকের সপ্তম স্পিকার করা হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ ‘সময় শেষ’ দেখানো হয় ঘডি়তে৷ কেন্দ্রের তরফে ওই দাবির সত্যতা যাচাই করে দেখেছে প্রেস ইনফরমেশন বু্যরো (পিআইবি)৷ তাঁদের তরফে জানানো হয়েছে, এই দাবি ‘বিভ্রান্তিকর’৷ মমতা বৈঠকে নিজের কথা বলার সময় পেয়েছিলেন৷ ঘডি় অনুযায়ী, তাঁর বলার সময় পেরিয়ে গিয়েছিল৷ তার পরেও তাঁকে সতর্ক করতে কোনও ঘণ্টা পর্যন্ত বাজানো হয়নি৷ এই দাবির প্রেক্ষিতে পিআইবির তরফে এক্স (সাবেক টু্যইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করা হয়েছে৷ সেখানে মমতার বক্তব্যের ভিডিয়োর উপরে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘বিভ্রান্তিকর’৷

এদিন বৈঠক থেকে বেরিয়ে মমতা জানান, তাঁর আরও কিছু কথা বলার ছিল বৈঠকে৷ তিনি সেখানে বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন৷ বিরোধীদের তরফে একমাত্র তিনিই যে বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাতে কেন্দ্রের খুশি হওয়ার কথা৷ তা না হয়ে বাংলাকে বঞ্চনার প্রসঙ্গে কথা শুরু করতেই থামিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ৷ রাজ্যের স্বার্থে এখানে এসেছিলাম৷ কিন্ত্ত বৈষম্যমূলক আচরণ করে আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ কেন তাঁকে পাঁচ মিনিটের বেশি বলতে দেওয়া হল না, তা নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরেই ক্ষোভ উগরে দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী৷ পাঁচ মিনিট ধরে বৈঠকে তিনি কী বলেছেন সেই প্রসঙ্গে মমতা জানান, ‘আমি বলেছি আপনাদের (কেন্দ্রীয় সরকার) কোনও রাজ্য সরকারের প্রতি বৈষম্য করা উচিত নয়৷ আমি আরও কথা বলতে চেয়েছিলাম৷’ মমতা আরও বলেন, ‘চন্দ্রবাবু নায়ডুকে ২০ মিনিট বলতে দেওয়া হয়েছে৷ অসম, গোয়া, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রীকে ১০ থেকে ১২ মিনিট বলতে দেওয়া হয়েছে৷ আর আমাকে পাঁচ মিনিটও বলতে দেওয়া হয়নি৷ বাজেটে কিছু নেই, জিরো৷ বৈষম্য করা হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোও এটা কী সম্ভব? সকলের দিকে নজর দিতে হবে৷ এভাবে সরকার চলে না৷ এদিনের বৈঠকে প্ল্যানিং কমিশন ফিরিয়ে আনার দাবি জানান মমতা৷ তাঁর বক্তব্য, নীতি আয়োগের সেই অর্থে নীতি লাগু করার আর্থিক ক্ষমতা নেই৷ যা যোজনা কমিশনের ছিল৷ ফলে নীতিমালা তৈরি হলেও তা কী করে লাগু করবে নীতি আয়োগ, প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীর৷

উল্লেখ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম নন যিনি কেন্দ্রের মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মাইক বন্ধের অভিযোগ তুলেছেন, এর আগে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি একাধিক বার লোকসভায় তাঁর মাইক বন্ধের অভিযোগ তুলেছেন৷ এবার অঙ্গরাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকেও নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মাইক বন্ধ করে বিরোধীদের ‘কণ্ঠরোধ’-এর অভিযোগ উঠল৷ প্রসঙ্গত, শুক্রবার দিল্লি যাওয়ার আগেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা৷ তাঁর অভিযোগ ছিল, বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনা করা হয়েছে৷ মমতা বলেছিলেন, ‘বাজেটে যে ভাবে বিরোধী রাজ্যগুলিকে বঞ্চনা করা হয়েছে, সেটা মানতে পারছি না৷ এক দিকে ইকনমিক ব্লকেড, পলিটিক্যাল ব্লকেড, এর সঙ্গে বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা, তার চরম নিন্দা করছি৷ মন্ত্রী সংসদে দাঁডি়য়ে বাংলা ভাগের কথা বলছেন!’

তাঁর ওই মন্তব্যেই বৈঠক থেকে ওয়াক আউটের ইঙ্গিত ছিল বলে বিজেপির একাংশের অভিযোগ৷ এর আগেও মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে তাঁকে বলতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা৷ শনিবার দেখা গেল, মমতার অনুমানই সঠিক৷ যার প্রতিবাদে তিনি বৈঠক ছাডে়ন৷

মমতার অভিযোগের পরই মাঠে নেমে পড়েন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের মতো মন্ত্রীও৷ কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন৷ আমরা সবাই ওঁর কথা শুনেছি৷ প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীকে একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল বক্তব্য রাখার জন্য এবং নির্ধারিত সময় প্রতিটি টেবিলের সামনে রাখা স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল৷ উনি মিডিয়ায় বলেছেন যে ওঁর মাইক অফ করে দেওয়া হয়েছিল৷ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন যে তাঁর মাইক অফ করে দেওয়া হয়েছিল৷ মিথ্যার উপরে কাহিনি তৈরি না করে, ওঁর উচিত সত্য বলা৷’

প্রসঙ্গত, এর আগেও বহুবার মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তুলেছেন যে বৈঠকের একদম শেষে তাঁকে বলতে দেওয়া হয়৷ অত্যন্ত কম সময় পান বক্তব্য রাখার৷ যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ বরাবরই উডি়য়ে দিয়েছে কেন্দ্র৷ এবারের অভিযোগও উডি়য়ে দেওয়া হল একইভাবে৷

প্রসঙ্গত, কংগ্রেস শাসিত তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী— কর্ণাটকের সিদ্দারামাইয়া, তেলঙ্গানার রেবন্ত রেড্ডি, হিমাচল প্রদেশের সুখবিন্দর সিংহ সুখু আগেই কেন্দ্রীয় বাজেটে বঞ্চনায় প্রতিবাদে নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা করেছিলেন৷ তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্ট্যালিন, আম আদমি পার্টির নেতা তথা পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা পিনারাই বিজয়নও বৈঠক বয়কট করেন একই অভিযোগে৷ মমতা জানিয়েছিলেন, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন বৈঠকে থাকতে পারেন৷ কিন্ত্ত তিনিও শনিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে গরহাজির ছিলেন৷ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকে ছিলেন না বিজেপির সহযোগী জেডিইউর প্রধান তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও!