‘এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে, কী উৎসবের লগনে। সব আলোটি কেমন করে ফেলো আমার মুখের পরে…।’ শারদীয়ার উৎসবকালে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনটা সুপ্রযুক্ত হতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। এবার সত্যিই একের পর এক পুজো উদ্বোধনের মাধ্যমে ফ্ল্যাশলাইটের সব আলো কেড়ে নিলেন একা মমতাই। মহালয়া থেকে তিনি শুরু করেছিলেন পুজো উদ্বোধন।
তারপর থেকে একের পর এক পুজো উদ্বোধন করে চলেছেন তিনি। শুক্রবার পর্যন্ত পঁচিশটিরও বেশি পুজোর সূচনা হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। কোথাও গিয়ে তিনি তুলির টানে মাতৃপ্রতিমার চক্ষুদান করেছেন, আঁকছেন, কোথাও গিয়ে রেখায় আঁকিবুকিতে দুর্গার প্রতীকী মুখ আঁকছেন, কোথাও শুধু ফিতে কাটছেন তো আবার কোথাও গিয়ে কোভিড সচেতনতা কিংবা ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রচার চালাচ্ছেন।
আর এভাবেই প্রতিটি পুজো মণ্ডপে প্রচারের সব আলোটি পড়ছে তার মুখের পরে। করোনা পূর্ব শারদীয়ায় পুজো উদ্বোধনে এসেছেন মহিমা চৌধুরী, শত্রুঘ্ন সিন্হার মতো বলিউড স্টার, সনৎ জয়সূর্য, ব্যারোটোর মতো ক্রীড়া জগতের তারকা, এমনকী বিশিষ্ট শিল্পীরা। প্রখ্যাত সরোদবাদক আমজাদ আলি খানও একবার পুজো উদ্বোধনে কলকাতায় এসেছিলেন। করোনার জন্য স্টারদের পুজো উদ্বোধনে ভাটা পড়লেও গত বছর রাজ্যপালকেও একাধিক পুজো উদ্বোধন করতে দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু এবার পুজোর ময়দানে আর দেখা যাচ্ছে না কাউকেই। সেই জায়গায় মহালয়া থেকে একগুচ্ছ পুজো উদ্বোধন করে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেসব পুজো উদ্বোধন করেন, সেই তালিকায় ছিল একডালিয়া এভারগ্রিন, ফাল্গুনী সংঘ, সিংহী পার্ক, বালিগঞ্জ কালচারাল, হিন্দুস্তান পার্ক, সমাজসেবী সংঘ, শিব মন্দির, মুদিয়ালি, ৬৬ পল্লী , বাদামতলা আষাঢ়সংঘ, সংঘশ্রী, মুক্ত দল, ত্রিধারা ইত্যাদি পুজো।
একুশের পুজোর আগেই উপনির্বাচনের উত্তাপে শুকিয়ে গিয়েছে পদ্ম। উনিশ সাল থেকে বাংলা দখলের মনোবাঞ্ছণ নিয়ে পুজোর সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছিল বিজেপি। বাঙালির ভাবাবেগকে ছুঁতে দুর্গাকে নিয়ে রাজনৈতিক উৎসবে মেতেছিল। এবার গেরুয়া শিবিরে পুজোর আনন্দ নেই। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ইজেডসিসি’র দুর্গাপুজোর মূল উদ্যোক্তার দায়িত্ব যাঁকে দেওয়া হয়েছিল, বৃহস্পতিবার সেই সব্যসাচী দত্ত তৃণমূলে যোগদান করায়, সেই পুজোও এবার উৎসবের আগে ধাক্কা খেল।
অন্যদিকে বাংলার পুজো এবার মমতাময়। বাগুইহাটির নজরুল পার্ক উন্নয়ন সমিতির ফাইবার গ্লাসের মা দুর্গার মুখ এবার প্রিয় ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রে আদলে। সম্প্রতি সেই মূর্তির চক্ষুদান করলেন ভবানীপুরের বাসিন্দা তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র। ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ায় বাংলার ‘নিজের মেয়ে’কেই তুলে ধরা হয়েছে অন্তত পাঁচটিপুজোর থিমে।
ভবানীপুরের মহেশ চৌধুরী লেনে স্বাধীন সংঘের পুজোর থিম তৈরি হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘গর্জে ওঠো’ কবিতার ওপর ভিত্তি করে। নেত্রীর আন্দোলনের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে ভবানীপুর দুর্গোৎসব এই পুজোর মণ্ডপসজ্জা হয়েছে। বকুলবাগানে সমিতির প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে মমতার রাজনৈতিক স্লোগান ‘খেলা হবে’ ওপর ভিত্তি করে।
ওপেন এয়ার স্টেডিয়ামের আদলে মণ্ডপে ফুটবল নেট, ফুটবলের ম্যুরাল। চক্রবেড়িয়া সর্বজনীনের পুজোর থিম হল ‘অপরাজিতা’। যেখানে মহাভারতের দ্রৌপদী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রামী ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। ভবানীপুরের উপনির্বাচনে যেভাবে মমতা বিরাট জয় পেয়েছেন, সেই সুত্রে তাকে ‘অপরাজিতা’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
এমনটাই ভাবছেন এই পুজোর কর্তাব্যক্তিরা। ভবানীপুরে ৭৫ পল্লীর পুজোর থিম মানবিকতা। পুরুলিয়ার চরিদা গ্রামে ছৌ-এর মুখোশ শিল্পীদের মাধ্যমে সেই মানবিক মুখ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানেও মমতাময়ীর মুখের ছায়া পড়েছে।
ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের পুজোতে আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি ‘শ্রী’ ফুটে উঠেছে দেবীর মহিমায়। ভবানীপুরের উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয়ের জন্য যে সেখানকার বাসিন্দা মনে মনে তৈরিই ছিল এইসব থিম নির্মাণই তার প্রমাণ।
শুধু উপনির্বাচন কেন, একুশের বিধানসভায় মমতার একচেটিয়া জয় এবং প্রবল প্রতাপ মোদিশাহকে পর্যুদস্ত করার রাজনৈতিক অস্ত্র ছিল মমতার হাতেই। তাই এবারের শারদীয়ায় মমতাই হয়ে গিয়েছেন ‘মোদিশাহসুরমর্দিনী’।