তাঁর কণ্ঠের সুর শােনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে তামাম ভারতের মানুষ। ঠিক ততটাই উৎকণ্ঠা নিয়ে সােমবার দিনভর মানুষ অপেক্ষা করছে তাঁর শারীরিক কুশল সংবাদ শােনার জন্য। রবিবার মাঝরাতের পর সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরকে তাঁর শ্বাসকষ্টের চিকিৎসার জন্য মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। প্রবাদপ্রতিম এই সঙ্গীতশিল্পীর চিকিৎসার পর বাড়ি ফেরার সংবাদ নিয়ে সােমবার দিনের শেষে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অ্যাডভাইসর ফারুক-ই-উদওয়াড়িয়ার তত্ত্বাবধানে ভেন্টিলেটর সাপাের্টে রাখা হয়েছিল তাঁকে। একটি সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী চিকিৎসার পর বাড়িতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। আবার অন্য একটি সংবাদ সংস্থার রিপাের্ট অনুযায়ী আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক। তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন তাঁর বােন আশা ভোঁসলে। পরস্পরবিরােধী এই সংবাদ বিভ্রান্তিতে লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে আমজনতার।
বলিউডের গুণমুগ্ধরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তবে সােমবার সন্ধের পর লতা মঙ্গেশকরের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানাে হয়েছে, লতাজি অসুস্থ হলেও আশঙ্কা নেই। ভাইরাল ইনফেকশনের জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য তিনি অনেকটাই সুস্থ রয়েছেন।
দু’মাস আগেই নব্বই বছর পূর্ণ করেছেন এই শিল্পী। ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে সব সম্মানের রত্নমুকুট তাঁর পাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর আসল স্থান আপামর ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায়। তাঁর কণ্ঠের জাদুতেই তিনি বহু বছর ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তাঁর শ্রোতাদের।
হিন্দি গানে লতা মঙ্গেশকরের প্লে-ব্যাক ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। অবশ্য শুধু হিন্দিই নয় মারাঠি এবং বাংলা ভাষাতেও অসংখ্য গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর । ১৯২৯ সালে এক সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্ম লতা মঙ্গেশকরের। পিতা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে তাঁর সঙ্গীতের হাতেখড়ি। পিতা দীননাথের মৃত্যুর সময় লতা মঙ্গেশকরের বয়স মাত্র তেরাে বছর। পাঁচ ভাই বােনের মধ্যে সবচেয়ে বড় লতা মঙ্গেশকর। ওই বয়সেই সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন জীবিকার সন্ধানে। মারাঠি সিনেমার ছন্দময় গানে লতাজির গলা সকলের নজর কাড়ল।
১৯৪৫ সালে মহল সিনেমায় মধুবালার লিপে, লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি সকলকে জানিয়ে দিল বলিউড দুনিয়ায় নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কোন ‘আনেওয়ালা’ এসেছে সকলের মন জিতে নিতে। এরপর থেকে তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমশ তাঁকে সম্রাজ্ঞীর আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে। মার্গ সঙ্গীতের আধারে তৈরি নওশাদ-এর বৈজু বাওয়রা , মাদার ইন্ডিয়া , মুঘল-ই-আজম , শঙ্কর-জয়কিশনের বরসাত , শ্রী ৪২০ সলিল চৌধুরীর মধুমতী – বিভিন্ন ধারার সঙ্গীত পরিচালকের কাছে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে প্রশংসা আদায় করে নিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর । এমনই তাঁর কণ্ঠসম্পদের বর্ণময় বিচ্ছুরণ।
পরিচয় , কোরা কাগজ , লেকিন– সিনেমায় নেপথ্যশিল্পী হিসেবে তিন তিনবার জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। পাখিজা , অভিমান , অমর প্রেম , আঁধি , সিলসিলা , চাঁদনি , সাগর , রুদালি , দীলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে – বিভিন্ন সময়ের সৃষ্টি সঙ্গীতের ভূমিতে লতা মঙ্গেশকরের সােনার কণ্ঠ উর্বরা হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সােনার ধান বুনে দিয়েছে।
লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া দেশাত্মবােধক গানগুলির মধ্যে অন্যতম আয়ে মেরে ওয়তন কে লােগাে গানটি ১৯৬৩ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে গেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং রাষ্ট্রপতি এস রাধাকৃষানের উপস্থিতিতে। সেই গান ছিল ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধে নিহত শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
শুধু সঙ্গীতে কণ্ঠদানই নয়, বহু মারাঠি সিনেমার জন্য তিনি সঙ্গীত রচনাও করেছেন। এজন্য মহারাষ্ট্রের সরকার তাঁকে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের সম্মান দিয়েছেন। লেকিন নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযােজনাও করেছেন লতা মঙ্গেশকর । তাঁর দ্রুত আরােগ্যের জন্য তাকিয়ে রয়েছে আমজনতা।