শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আমেরিকার আদালত। সৌরবিদ্যুতের চুক্তির জন্য বিশেষ শর্তের বিনিময়ে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ২৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২২০০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে গৌতম আদানি এবং তাঁর ভাইপোকে অভিযুক্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই ঘুষ ও জালিয়াতিকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ ৬ জনের বিরুদ্ধে। আমেরিকার আদালতে প্রমাণ-সহ অভিযোগপত্র জমা পড়েছে বৃহস্পতিবার। তার জেরে ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি এবং তাঁর সহযোগীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ তাঁরা বিভিন্ন রাজ্যে বাজারের থেকে বেশি দামে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির বরাত আদায় করেছিলেন। অভিযোগ, সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির বরাত পেতে অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের ঘুষও দিয়েছিলেন আদানিরা। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে অন্ধ্রের এক শীর্ষস্থানীয় আমলার বিরুদ্ধে। অন্ধ্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডি এবং তাঁর দল ওয়াইএসআর কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
আদানি ঘুষকাণ্ডে এবার নাম জড়াল অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিওরিটি ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের অভিযোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থার চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের জন্য ১৭৫০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন আদানি।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে অন্ধ্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির সঙ্গে নাকি ঘুষের ব্যাপারে সমঝোতা করতে দেখাও করেছিলেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। এই বিস্ফোরক অভিযোগও করেছে আমেরিকার কমিশন। সেই সাক্ষাতের সময়েই ঘুষ দেওয়া হয়েছিল অথবা ঘুষের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি। কমিশনের আরও দাবি, ওই সাক্ষাতের বেশ কয়েকদিন পর সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার থেকে ৭ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে রাজিও হয়ে যায় অন্ধ্রপ্রদেশ। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাকি রাজ্যগুলির থেকে যা অনেকটাই বেশি। আমেরিকার গোয়েন্দাদের দাবি, সোলার এনার্জি কর্পোরেশন ক্রেতা খুঁজে না পাওয়ায় সরকারি আধিকারিকদের ঘুষ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে আদানি ও আজ্জ্যুয়ার পাওয়ার।
অভিযোগ, ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘আদানি গ্রিন’-এর কাছ থেকে সোলার এনার্জি কর্পোরেশন ৮ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে। ৪ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে সমঝোতা হয় দিল্লির সংস্থা ‘ আজ্জ্যুয়ার পাওয়ার’-এর সঙ্গে। অভিযোগ , তার পরেই অন্ধ্র, ওড়িশা, ছত্তিশগড় তামিলনাড়ু এবং জম্মু ও কাশ্মীরে সোলার এনার্জি কর্পোরেশন যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহের বরাত পেতে পারে, তার জন্য উদ্যোগী হন আদানি।
যদিও এই অভিযোগ নস্যাৎ করেছে জগন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস। শুক্রবার তাদের তরফে একটি বিবৃতি জারি করে জানানো হয়, ‘আদানি গোষ্ঠী বা তার কোন শাখা সংগঠনের সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা চুক্তি সই করেনি। এমনকি, অন্য কোন সংস্থার সঙ্গেও সরাসরি সমঝোতা করা হয়নি। রাজ্য সরকারের উপর যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যে।’ জগন সরকারের আমলের এই অনিয়মের অভিযোগও সঠিক নয় বলে দাবি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত অন্ধ্রে ক্ষমতায় ছিল ওয়াইএসআর কংগ্রেস।
ওয়াইএসআর কংগ্রেস-এর আরও দাবি, ২০২১ সালের নভেম্বরে ৭ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহে ছাড়পত্র দিয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ বিদ্যুৎ রেগুলেটরি কমিশন। তার আগে অন্ধ্রের সরকারকে ২.৪৯ টাকায় ১ কিলোওয়াট -আওয়ার হিসেবে ২৫ বছর বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি কর্পোরেশন। ওই বছরেই পয়লা ডিসেম্বর চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয় বলে দাবি।
রেড্ডির দলের আরও দাবি, সোলার এনার্জি কর্পোরেশনের সঙ্গে ওই চুক্তি অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন। এই প্রকল্পের ফলে রাজ্য লাভবান হয়। সস্তায় বিদ্যুৎ পেয়ে বার্ষিক ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পর্যন্ত সঞ্চয় হয় রাজ্যের তহবিলে।
নিউইয়র্কের আদালত বৃহস্পতিবার গৌতম আদানি ও সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সোলার এনার্জি সরবরাহের বরাত পেতে সরকারের শীর্ষকর্তাদের ২৬.৫ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আদানি কর্তাদের বিরুদ্ধে। যদিও গোটা ঘটনা নিয়ে অন্ধ্রের শাসকদল টিডিপি এখনও মুখ খোলেনি। রিপোর্ট খতিয়ে না দেখে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ তারা।
এদিকে আদানিকাণ্ডের জেরে শুরু হয়ে গিয়েছে বিদেশের চুক্তি বাতিল পর্ব। আদানি সংস্থার সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল করেছে কেনিয়া। সে দেশের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের্ পরিকাঠামো তৈরিতে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, এই চুক্তি নিয়ে এমনিতেই কেনিয়ায় বিক্ষোভ-বিতর্ক ছিল। আপত্তি ছিল কেনিয়াবাসীরও।
আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে বাংলাদেশ সরকারও বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে নতুন করে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করতে পারে বলে জানা গিয়েছে। হাসিনা সরকারের সঙ্গে আদানিদের চুক্তি নিয়ে গোড়া থেকেই নানা প্রশ্ন ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার আগেও চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিল। ফলে এবার চাপ বাড়াতে পারে বাংলাদেশও।
এদিকে আমেরিকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনজীবী রবি বাত্রা এক সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে সক্রিয় হতে পারেন অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রেয়ন।’ আমেরিকার আইন মোতাবেক, ভারতীয় নাগরিক গৌতম আদানি , সাগর আদানিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের দায়িত্ব ‘বিদেশ বিষয়ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’র। আর দায়িত্ব হস্তান্তরের ভার বর্তায় অ্যাটর্নি জেনারেলের উপর ।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই সেই দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে নিউ ইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট আদালতের সরকারি কৌঁসুলিরা। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আদানির প্রত্যর্পণের জন্য আমেরিকার বিদেশ দপ্তরের দ্বারস্থ হতে পারে ‘বিদেশ বিষয়ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’।
তবে আদালতের নির্দেশ জারির পর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে মার্কিন পুলিশকে। তবে বিশেষজ্ঞ মহলের অনুমান, এক্ষেত্রে ২০১০ সালের ভারত-মার্কিন প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ীও পদক্ষেপ করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন আদালত মারফত ভারত সরকারকে বলতে পারে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে তাদের হাতে তুলে দিতে।