অর্ধেক বেতন দিয়ে নির্দেশ ‘পদত্যাগ পত্র’ পাঠানোর

দেশজুড়ে লকডাউন (File Photo by SANJAY KANOJIA / AFP)

দেশের আইন, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, সর্বোপরি নির্বাচিত সরকার কাদের জন্য এখন তা বোঝা যাচ্ছে। গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভের মধ্যে তিনটি স্তম্ভ আইন প্রণয়ন, বিচার ও শাসন ব্যবস্থা যে সাধারণের কোনও কাজে লাগানো হয় না বা হবে না, তা করোনা মোকাবিলায় লকডাউনের সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন সাধারণ মানুষ।

করোনা মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণার সময়ে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন দেশে সকল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, উৎপাদনশীল কলকারখানা সবই বন্ধ থাকবে। লকডাউনের মেয়াদ প্রথম দফায় একুশ দিন, পরে তা তিন দফায় বাড়িয়ে ৩১ মে পর্যন্ত করা হয়েছে।

এসময় মানুষ ঘরবন্দি। এটা সরকারি নির্দেশ। ফলে কাজ কাম সব শিকেয়। কিন্তু এসময় যাতে কোনও কর্মীকে ছাঁটাই না করা হয় তার অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী বন্ধ থাকার সময়ে কর্মীদের বেতনও যাতে দেওয়া হয় তারও অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। একই সুরে কথা বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাও।


কিন্তু দুই মাস লকডাউনের জেরে বন্ধ থাকা ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই ‘হোয়াস অ্যাপের’ মাধ্যমে কর্মীদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে। এমনকী তাদের দুই মাসের বেতন না দিয়ে দু’মাসের ক্ষেত্রে বেতন কেটে নিয়ে মাত্র এক মাসের বেতন দিচ্ছে।

রাজ্যের বেসরকারি সংস্থার এক মালিক আবার একধাপ এগিয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছাঁটাই না করা বা বেতন না কাটার অনুরোধের উত্তরে সংবাদ মাধ্যম মারফত জানিয়ে দেন সরকার কর্মীদের বেতনের দায়িত্ব নিলে তবেই ছাঁটাই না করার বিষয়টি চিন্তা করা হবে।

কর্মী নিয়োগের সময়ে সংস্থাগুলি যে সব শর্ত আরোপ করে তার পরে আদালতে গেলেও শ্রমিক বা কর্মী যে কোনও সুবিধা পাবেন না সেটা সকলেরই জানা। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আবার কেন্দ্রীয় সরকার সংস্কারের নামে শ্রম আইনের সংশোধন করেছেন। এর ওপর আছে খরচের বিষয়টি। মালিকপক্ষ তাদের সুবিধার জন্য পয়সা ছড়ালেই তা কিনতে পারেন।

দেশের শ্রম আইন সবই মালিকের সুবিধার জন্যই রচিত হয়েছে। কারণ তারা পয়সা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছে এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। ফলে কর্মীদের সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা না রাখলেও ক্ষতি নেই।

এব্যাপারে সরকার, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন নীরবই থাকে। ভারতের মতো বিশাল দেশে কর্মীদের এমন অসহায় হয়েই কাজ করতে হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা সকলেই চাক্ষুশ করার সুযোগ পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি একে অপরের ওপর দোষারোপ করেই তাদের দায়িত্ব সেরেছেন। তবে সরকার কার জন্য-এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

শ্রমিক সংগঠনগুলি শ্রমিকদের জন্য যে আন্দোলনের নাটকের অবতারণা করে তার পরিসমাপ্তি ঘটে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটিকে অচল করে দিয়ে কর্মীদের সম্পূর্ণ বেকার করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। ফলে তাদের ওপর ভরসা করারও কিছু নেই। নিজেদের লোকই তাদের ঠকাচ্ছে।

লকডাউনের মতো পরিস্থিতি দেশে কখনও হয়নি বা বলা যায় শতাব্দীতে দেখা যায়নি। তাই এই অবস্থাটাকে বিশেষ অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করেও বিভিন্ন সংস্থার মালিকরা কর্মীদের বেতন কেটে নিয়েও ছাঁটাই না করলেই মঙ্গল হয় সর্বাঙ্গীন। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কর্মীদের হোয়াটস অ্যাপে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

সংস্থার পক্ষে ছাঁটাই করা হচ্ছে না। সংস্থাগুলি আইন মেনেই একাজ করছে। কর্মীদের জানানো হচ্ছে পদত্যাগ না করলে বেতন কাটা হবে বা অভিজ্ঞতার শংসাপত্র দেওয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে কর্মীরা বকেয়া বেতন পাওয়ার আশায় পদত্যাগ করছেন।

ফলে দেশের প্রধান প্রশাসক প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যের প্রধান প্রশাসক মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা বা অনুরোধ যে কথার কথা, সেটা সকলেই বুঝতে পারছেন। যদিও নির্বাচিত প্রধান প্রশাসকরা সকলেই সাধারণ এবং সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত। কিন্তু তারাই ক্ষমতায় বসে সাধারণ মানুষের কথাটাই ভুলে মেরে দিচ্ছেন। ক্ষমতার দম্ভে সমালোচকদের পুলিশি হেনস্থার ভয় দেখাচ্ছেন। আবার ভোটের সময় হাত জোড় করে ভোট চাইছেন।

এমন অস্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ কাজ হারিয়ে, বেতন হারিয়ে কিভাবে চলবে তার কোনও হদিশ কিন্তু প্রধান প্রশাসকরা দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন, আত্মনির্ভর হোন। শুধু একটু কষ্ট করুন। কিন্তু ক্ষমতা দখল করে তারা যে সুবিধা পাচ্ছেন, তা যে সাধারণের আওতার শত যোজনের মধ্যে নেই, সেটা না বললেও সকলেই বুঝতে পারছেন।

লকডাউনের মধ্যে আবার পশ্চিমবঙ্গে আম্ফানের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষি, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে। পাকা ধান মাঠেই পড়ে রয়েছে জলের তলায়। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। শতবর্ষ প্রাচীন সব গাছ উপড়ে রাস্তায় অবরোধের সৃষ্টি করেছে। পাঁচ দিন হয়ে গেলেও শহর কলকাতার রাস্তা থেকেই সব গাছ সরানো যায়নি। এরই মধ্যে হোয়াটস অ্যাপে কাজ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ আসছে। তবে সাধারণ মানুষের বাঁচার আর উপায় কি?

গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমের বহু কর্মী লকডাউনের সময়ে কাজে আসতে পারছেন না। কিছুটা দূরে থাকার জন্য পরিচালকরা শহরের মধ্যে ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে যারা রয়েছেন তাদের নিয়ে এসে কাজ সারছে, বাকিদের বাড়িতে বসেই কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধা যাদের নেই তারা একেবারেই বসে রয়েছেন। তাদের দুই তিন মাসের বেতনও পাঠানো হচ্ছে না।

সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরও যদি এমনভাবে হেনস্থা করা হয় তবে সাধারণ উৎপাদন সংস্থার মালিকরা যে তাদের কর্মীদের দুই মাস বন্ধ থাকার সময়ের জন্য বেতন দেবেন না তা বলাই বাহুল্য। সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাঁটাইও চলছে বলে অভিযোগ। ফলে করোনা, লকডাউন, আম্ফানের ত্র্যহস্পর্শে কর্মীদের প্রাণঘাতী অবস্থা।