ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক কোনওদিন স্থাপিত হবে কিনা, তা নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে জল্পনা-কল্পনা হতে পারে। সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের পাকিস্তানে ২৪ ঘণ্টার সফর এবং পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে পৃথক আলোচনায় সেই জল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সম্প্রতি ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন এসপিও দেশভুক্ত দেশগুলির বৈঠকে যোগ দিতে। জয়শঙ্করের সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রীর যৎসামান্য আলোচনায় আশার আলো দেখা দিয়েছে— তাহলে কি দুই দেশের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যের সৃষ্টি হবে? জয়শঙ্কর পাকিস্তান থেকে ফেরার সময় পাকিস্তানের আতিথ্য, সৌজন্যতার প্রশংসা করেছেন। এই নয় বছর পর ভারতের কোনও মন্ত্রী পাকিস্তানে গেলেন এবং পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলোচনা করলেন— যা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার সম্ভাবনা দেখছে। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শুধু সম্ভাবনাই, বাস্তবে কিছু হওয়ার নয়।
গত বছর এসসিওভুক্ত দেশগুলির সম্মেলন হয়েছিল গোয়ায়। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো। তিনি তাঁর বাক্যবাণে ভারতকে বিদ্ধ করেছিলেন এবং তিক্ততা চরমে উঠেছিল। কিন্তু জয়শঙ্করের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি, বরং ভারতের এই বিদেশমন্ত্রী সম্মেলনে যা বলেছেন, তা গঠনমূলক। দুই দফায় আলোচনা হল ভারতের বিদেশমন্ত্রী এবং পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, তাতে কোনও তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি। মধ্যাহ্নভোজে জমিয়ে গল্পও করলেন তাঁরা। সুতরাং জয়শঙ্করের আচরণে খুশি পাক নেতৃবর্গ।
পাকিস্তানের জলন্মলগ্ন থেকেই তার প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তিক্ততার সৃষ্টি হয়ে চলেছে। কোনও সময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোনও উন্নতি দেখা যায়নি বরং বৈরতা চলেছে। যদিও জয়শঙ্করের সফরের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের যে তিক্ততা চলছে, তা কিছুটা কাটার আভাস মিলেছে। কিন্তু এটি শুধু কথার কথা, কারণ পাকিস্তান সন্ত্রাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের সীমান্তে জঙ্গিদের পুষে রেখেছে মাঝে মাঝে নাশকতামূলক কাজের জন্য। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তাঁর আমলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে দ্বৈরথের সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান হবে। এবং তিনি চেষ্টা করবেন সম্পর্কের আরও উন্নতি করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তাঁর শাসনকালেও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল। যদিও বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটবে যাতে শক্তিসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে যৌথভাবে মোকাবিলা করতে সুবিধা হবে। অবশ্য পাকিস্তান যদি গঠনমূলক আলোচনা নিয়ে এগিয়ে আসে।
পাকিস্তানের বর্তমান শাসক জোটের প্রধান জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে একটি সুসম্পর্কের অভাস মিলেছে বটে, কিন্তু দিল্লির সাউথ ব্লক মনে করে না সেই উন্নতির কথা। কারণ পাকিস্তান সবসময়েই বারতের সম্পর্কে নানা বিষয়ে অবান্তর ও অবাস্তব অভিযোগ এনে চলেছে। পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যে দেশ তিন-তিনবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে চরম পরাজয় বরণ করেছে। তারপরও পাকিস্তান এই পরাজয় থেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি। কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গি হানা, নাশকতামূলক কাজ, ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া— এই সব কাজগুলি যে পর্যন্ত চালিয়ে যাবে, সে পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনও উন্নতি আশা করা যায় না বলে দিল্লির সাউথ ব্লক মনে করে। অপরদিকে, সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে পাক প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ছিল ভারত বিরোধী বয়ানে ভরা। তিনিই আবার জয়শঙ্করের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ বাক্যালাপ করেছেন। সুতরাং পাক প্রধানমন্ত্রীর দুই সুর নিয়ে কথা বলাই যায়।
আসলে বর্তমান পাকিস্তানের জোট সরকার পাকসেনা কর্তৃপক্ষের কথায় চলে। অতীতের পাক সরকারও ছিল তাইই। বর্তমানে পাকিস্তানে আর্থিক সংকট তীব্র। চলছে হিংসা, অস্থিরতা ও মন্দা। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য। এই অবস্থার মধ্যেও পাকিস্তান ভারত-কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গিদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের অনমনীয় মনোভাব বিশ্বের সামনে তুলে ধরেই চলেছে ভারতের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের।
সুতরাং নয়াদিল্লি মনে করে পাকিস্তান কাশ্মীর গিয়ে তার মনোভাব পরিবর্তন না করলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির কোনও আশা একেবারেই নেই। পাকিস্তান যে পর্যন্ত না সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করবে এবং কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গি হানা বন্ধ করবে, সে পর্যন্ত এই দুই দেশ যে দ্বৈরথ নিয়ে চলছে, সেই দ্বৈরথ নিয়েই চলবে। জয়শঙ্করের সফর এবং পাক প্রধানের সঙ্গে তাঁর বাক্যলাপে গলে যাওয়ার মতো কিছু নেই।