• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

অমৃত গুহার সন্ধানে

সুখেন্দু হীরা: অবশেষে দমদম এয়ারপোর্টে প্রবেশ করলাম। বেলা একটা পঁচিশে ফ্লাইট। যাব শ্রীনগর। প্লেনটা অবশ্য সরাসরি যাবে না। চণ্ডীগড় হয়ে যাবে। সে যাক! উড়োজাহাজে যাচ্ছি, সময় বাঁচাতে। কোথায় যাচ্ছি, সেটা তো বলিনি! যাচ্ছি অমৃত গুহার সন্ধানে। যাচ্ছি অমরনাথ। যতটা না বরফানি বাবা অর্থাৎ বরফের শিবলিঙ্গ দর্শন করতে, তার থেকে বেশি অমর গুহার দর্শনে। সেই সাথে অমৃত

সুখেন্দু হীরা: অবশেষে দমদম এয়ারপোর্টে প্রবেশ করলাম। বেলা একটা পঁচিশে ফ্লাইট। যাব শ্রীনগর। প্লেনটা অবশ্য সরাসরি যাবে না। চণ্ডীগড় হয়ে যাবে। সে যাক! উড়োজাহাজে যাচ্ছি, সময় বাঁচাতে। কোথায় যাচ্ছি, সেটা তো বলিনি! যাচ্ছি অমৃত গুহার সন্ধানে। যাচ্ছি অমরনাথ। যতটা না বরফানি বাবা অর্থাৎ বরফের শিবলিঙ্গ দর্শন করতে, তার থেকে বেশি অমর গুহার দর্শনে। সেই সাথে অমৃত পথের সন্ধানে। অমৃত মানে অমরত্ব। অমর গুহার পথকে বলতেই পারি অমৃত পথ।

দলে আটজন। ছ’জন প্লেনে, দু’জন ট্রেনে। ছ’জনের ছুটির অভাব বলে একটা পিঠের যাত্রা অর্থাৎ যাওয়াটা আকাশপথে রেখেছি। তাতেও ছুটি ১১ দিন নিতে হয়েছে। অবশ্য তিন দিন রাখা হয়েছে ‘বাফার’ হিসাবে। যদি প্রকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কারনে যাত্রা দু-একদিনের জন্য স্থগিত হয়, তাহলে সামাল দেওয়া যাবে।

এমনিতে একটা ছুটি নিতে গেলে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়। এবার কিন্তু সত্যিই অনেক ছোটাছুটি করতে হয়েছে। যাওয়ার আগে প্রথমে মেডিকেল টেস্ট। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পর রেজিস্ট্রেশন। অন্যান্য জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার মতো, মন করলেই পিঠে পিট্টু নিয়ে‌ বেরিয়ে পড়লাম, তা কিন্তু এখানে হবে না। রেজিস্ট্রেশনটা তবু একদিনে হয়ে যায়। কিন্তু বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বেশ কিছুদিন লাগে। সরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষা করতে হয়। একই দিনে সমস্ত পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। সরকারি হাসপাতালে এমনিতেই রুগীর অত্যধিক চাপ থাকে। তার মাঝে তীর্থযাত্রীদের পরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর সুস্থতার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে হাজির হবে জম্মু এবং কাশ্মীর ব্যাংকের শাখায়। এই ব্যাংকের শাখা আবার সর্বত্র নেই। তালিকা দেখে সেখানে হাজির হতে হবে। যেহেতু ব্যাংকে শাখা-প্রশাখা কম, তাই সেখানেও ভিড় জমে যায়। তাছাড়া সবাই প্রথমের দিকে যেতে চায়। কারণ তাহলে বরফের শিবলিঙ্গ দেখার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং তীর্থযাত্রীর চাপে রাস্তা ঘাট অতটা খারাপ হয়ে ওঠে না। এই কারণে রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য প্রথমদিকে একটা হুড়োহুড়ি থাকে।

তবে আমাদের অমরনাথ যাত্রা সলতে পাকানো শুরু হয়েছে প্রায় এক বছর আগে থেকে। গত বছর যখন অপর্ণা বলল আমি অমরনাথ যাচ্ছি। অপর্ণা আমার কলেজের বন্ধু। সরকারি চাকুরে। অপর্ণা বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থাৎ ওর স্বামীকে নিচ্ছে না। কারণ দুজনে এক সঙ্গে গিয়ে স্বর্গলাভ করলে একমাত্র মেয়েকে কে দেখবে?

অপর্না সত্য কথা বলেছে। হিমালয়ে অন্যান্য তীর্থযাত্রায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অমরনাথ যাত্রায় যুক্ত হয় উগ্রপন্থীদের আক্রমণের সম্ভাবনা।

অপর্ণার ফোন পেয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছার সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকা একটা ভ্রমণ ভাবনা ভেসে উঠল। ছেলেবেলা থেকে ভাবতাম দুটো জায়গা দেখতে যেতেই হবে এক তিব্বতের ‘মানস সরোবর’ আর দুই কাশ্মীরের ‘অমরনাথ’। ভূগোল বইতে যখন পড়তাম মানস সরোবর থেকে বহ্মপুত্র ও সিন্ধু নদ উৎপন্ন হয়েছে দুই দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে পড়েছে, মনটা তখন কেমন যেন উদাস হয়ে বয়ে যেত।

অমরনাথের আবিষ্কারের গল্পে যখন পড়েছিলাম এক মুসলিম মেষপালক মেষ চড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করে ‘তুষার লিঙ্গ’ সমন্বিত গুহা। আমারও মন তেমন মেষপালক বালকের মতো ভেড়া তাড়াতে তাড়াতে উঠে পড়তো হিমালয় পর্বতের সেই গুহায়। বরফে নির্মিত শিবলিঙ্গের আলৌকিক দর্শন নয়, প্রাকৃতিক সৃষ্টির অনুপম বিচিত্রতা আমায় টানত।

অপর্ণা অমরনাথ যাত্রা করে ফিরলে একদিন তার বেলঘরিয়ার বাড়িতে হানা দিলাম। তার মুখ থেকে শুনলাম ভ্রমণ কাহিনী। শুধু মহিলারা দল বেঁধে গিয়েছিল। এমনকি যাদের সঙ্গে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ নয়। অমরনাথ যাবে বলে মাস তিনেক আগে থেকে জোট বেঁধেছে। অপর্ণা ও তার মহিলার টিমের ইচ্ছা শক্তি দেখে আমিও পঞ্চাশোর্ধ বয়সে উদ্দীপ্ত হলাম। প্রস্তাব রাখলাম আমার বন্ধুবর্গের আগামী বছর ‘শ্রী অমরনাথজী যাত্রা’র।

আমার প্রস্তাব সানন্দে গৃহীত হল। কয়েকজন বন্ধুকে আলাদা করে ফোন করা হল। অবশেষে আটজনের দল গঠন হল। দলে সদস্য হলেন দীনেশ দা অর্থাৎ দীনেশচন্দ্র মণ্ডল, সঙ্গে পূর্ণিমা বৌদি। আমার সহকর্মী ভাতৃপ্রতিম দেবজ্যোতি চক্রবর্তী সঙ্গে তাঁর প্রিয়বন্ধু মেনাঙ্ক মজুমদার। তারকেশ্বরের রাজীব মাইতি, বাঁকুড়ার অমরকানন কলেজের প্রফেসর সৌমেন রক্ষিত, প্রসেনজিৎ কোলে এবং আমি। কাজও শুরু করে দিল প্রসেনজিৎ কোলের নেতৃত্বে দলবল। টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং সব তারাই সামলাচ্ছে।

ঠিক হল দীর্ঘযাত্রার ধকল সহ্য করার মতো শরীরকে উপযোগী করে তুলতে হবে। এর অন্যতম পন্থা প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণ। এই কারণে গত এক বছর এই রুটিনে ছেদ দিইনি। সপ্তাহে পাঁচ দিন কম করেও ৪০ মিনিট করে হাঁটতাম। বেশি হলে আপত্তি করিনি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে বা কর্মসূত্রে অন্যত্র রাত কাটালে পরদিন সকালে ‘মর্নিংওয়াক’ সেখানে সেরে নিয়েছি। এর ফলে সেই এলাকা ভ্রমণ হয়ে যেতো। এটা প্রাতঃভ্রমণের বাড়তি পাওনা। যার সুফল আমরা গত সেপ্টেম্বরে মেঘালয়ে দুই হাজার সিঁড়ি ভেঙে ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ এবং তারও নিচে ‘রেনবো ফলস’ দেখতে গিয়ে পেয়েছি।

অমরনাথ যাত্রার প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর আমার কাজ কার্যত শেষ হয়ে গেল। এই বছর শুরুতে একটা হোয়াটসঅ্যাপ খোলা হল সেখানে মাঝে মাঝে চোখ রাখতাম। কী ‘আপডেট’ হচ্ছে জানতে। অমরনাথের পবিত্র গুহায় যাওয়ার তিনটি পথ আছে। একটি পথ পহেলগাঁও (ওখানে বলে পহলগাম) দিয়ে চন্দনবাড়ি, শেষনাগ, পঞ্চতরণী, সঙ্গম টপ হয়ে অমরনাথ গুহা। অমরাবতী ও অমর গঙ্গা দুই নদী ‘সঙ্গম’-এ মিলিত হয়েছে। এই সঙ্গমস্থলের ওপর অর্থাৎ পাহাড়ের ওপরে পথের বাঁকটি ‘সঙ্গম টপ’ বলে পরিচিত। যা সাধোসত টপ, বা সন্তসিং টপ বলেও কোথাও কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় পথটি হলো সোনমার্গ বালতাল হয়ে। বালতাল থেকে আসা পথটি সঙ্গমের কাছে এসে পহলগাম থেকে আসা রাস্তায় মিলিত হয়েছে। বালতাল থেকে অমরনাথ গুহার দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। অন্যদিকে পহলগাম থেকে অমরনাথ গুহার দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে পহলগাম থেকে চন্দনবাড়ি ১৬ কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে আসা যায়। তারপর বাকি ৩২ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে, বা ঘোড়ায় চেপে, বা ডাণ্ডিতে চেপে অর্থাৎ দোলায় চেপে যেতে হয়।

তৃতীয় পথটি হল সোনমার্গ, জোজিলা গিরিপথ গুমরী, গুমরী গিরিপথ দিয়ে অমরগঙ্গা নদীর বুকে। এই পথ দিয়ে কাশ্মীরের শেষ মহারাজ হরি সিং যেতেন। এই পথ খুবই কষ্টকর, এই পথ দিয়ে সাধারণত তীর্থযাত্রী কেউ যায় না। ‘ট্রেকার্স’রা অভিযানের স্বার্থে এই পথ ব্যবহার করে থাকেন। সরকারিভাবে ‘যাত্রা’র ব্যবস্থা থাকে আগের দুটি পথ দিয়ে।

অনেকে পহলগাম দিয়ে উঠে বালতাল দিয়ে নামেন। বা উল্টোটাও করা যায়, অর্থাৎ বালতাল দিয়ে উঠে পহলগাম দিয়ে নামা যায়। এতে দুদিকের পথের প্রকৃতি দেখা যায়। অনেকে যে পথে ওঠেন আবার সেই পথেই নামেন। পহলগাম এবং বালতাল-এ প্রধান দুই বেস ক্যাম্প হয়।

অনেকে বালতাল দিয়ে উঠে একদিনে অমরনাথ দর্শন সেরে নেয়। এমনও দেখেছি রাত থাকতে শ্রীনগর থেকে যাত্রা করে ভোরবেলা বালতাল থেকে অমরনাথের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে। আবার ওই পথে নেমে শ্রীনগর ফিরে গেছেন। এক্ষেত্রে ঘোড়ায় করে উঠতে হবে নচেৎ সম্ভব নয়। তবে এরকম পরিকল্পনা না করাই ভালো। কারণ একদিনে নিম্ন উচ্চতার শ্রীনগর থেকে উচ্চ উচ্চতার অমরনাথ উঠলে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা হতে পারে। একদিন বালতালে বা পহমলগামে থেকে উচ্চ উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চললে যাত্রা শুরু করলে ভালো। এরকম সব বিশেষজ্ঞের মতামত আমরা লাভ করেছিলাম।

অপর্ণা বালতাল ক্যাম্পে একরাত থেকে একদিনে অমরনাথ হেঁটে উঠেছিল। সেদিনেই প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেভাবেই সে যাত্রার রেজিস্ট্রেশন করিয়ে ছিল। তার যুক্তি ছিল প্রথম দিন ঘোড়ার নাদিতে পথ দূষিত হবে না। ভাবনা ছিল অমরনাথ থেকে পহলগাম হয়ে নামবে। একটাই অসুবিধা হয়েছিল অমরনাথ থেকে পঞ্চতরণীর রাস্তায় গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে পথ তখনও সুগম হয়নি। তবে নানা অসুবিধার কারণে তাঁরা পঞ্চতরণী থেকে হেলিকপ্টারে পহলগাম চলে গিয়েছিল। পহলগামে হোটেলে উঠেছিল। অর্থাৎ একদিনে যাত্রা শেষ।

হেলিকপ্টারে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় অমরনাথের দ্বারে। পহলগাম ও বালতাল থেকে হেলিকপ্টার করে পঞ্চতরণী নামতে হয়। তারপর সেখান থেকে ৬ কিমি হেঁটে বা ঘোড়ায় বা ডাণ্ডিতে।

পহলগাম দিয়ে চন্দনবাড়ি হয়ে হাঁটাপথে অমরনাথ গুহার দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার আর বালতাল দিয়ে অমরনাথ গুহার দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। শুধু তাই নয় পহলগাম দিয়ে সাধারণত আসলে তিন দিন লাগে অমরনাথ গুহায় পৌঁছাতে। মাঝে দুদিন শেষনাগ ও পঞ্চতরণীতে রাত্রিবাস।