ঢাকা, ৫ অগাস্ট – চূড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন ঘটল। ঠিক একইভাবে প্রবল জনরোষের মাঝে্ দেশ ছেড়েছিলেন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামান। এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার আঁচ যাতে সীমান্ত এলাকাগুলিতে না পড়ে , সেজন্য চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার ভারত–বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেছে বিএসএফ। সোমবারই কলকাতা এসে পৌঁছেছেন বিএসএফের কার্যনির্বাহী প্রধান দলজিৎ সিং চৌধুরি। বিভি্ন্ন জায়গায় সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ওড়ার পর আগরতলা হয়ে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে শেখ হাসিনার সি–১৩০ বিমান। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কপ্টারে তিনি আগরতলা এসে পৌঁছন। জানা গেছে, বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে এই বিমান ভারতে ঢোকে। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত, গোবরডাঙা, মধ্যমগ্রাম হয়ে পৌঁছয় দমদম। দমদম থেকে আগরপাড়া খড়দহ, হয়ে যায় সিঙ্গুর । এরপর বর্ধমান–দুর্গাপুর হয়ে আসানসোল , ধানবাদ , লখনউ হয়ে হাসিনাকে দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন এয়ারবেসে নিয়ে আসা হয়। দিল্লির গাজিয়াবাদে সেনাবাহিনীর হিন্ডন এয়ারবাসে স্থানীয় সময় ৫টা ৩৬ মিনিটে অবতরণ করে শেখ হাসিনার বিমান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তারা তাঁকে স্বাগত জানান।
দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ভারতীয় সেনার আধিকারিকরা। সোমবার সন্ধ্যায় ভারতের মুখ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হাসিনার। পরিস্থিতি বুঝে তিনি রিপোর্ট করবেন প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রীকে। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন ভারতীয় সেনার বিশেষ বাহিনী। এদিকে্ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। এদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছেন লোকসভআর বিরোধী দলনেতা রাৈহগুল গান্ধিও।
সূত্রের খবর, এরপরই বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করে। আবার অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনা কয়েকদিন দিল্লিতে থাকবেন। এরপর তিনি লন্ডনে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনা ব্রিটেনের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে একটি সূত্রে জানা যায়। সেই আবেদন খারিজও হয় বলে সূত্রের খবর। ।
প্রায় দু-মাস ধরে অশান্ত বাংলাদেশে অবশেষে পতন ঘটল হাসিনা সরকারের। দ্বিতীয় দফায় রবিবার থেকে অশান্তির পর অবশেষে সোমবার গণভবনের দখল নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তারপরই সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। সোমবার দুপুর ৩টে নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেওয়ার পর দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। শুধুমাত্র কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীর ঘেরাটোপে গাড়ি থেকে নেমে সোজা সামরিক চপারে উঠে দেশ ত্যাগ করেন পঞ্চমবার জয়ী বাংলাদেশের সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে চপারে ওঠেন বোন রেহেনাও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই আন্দোলনকারীদের উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙে। গণভবনে ঢুকে তাণ্ডব চালানো, এমনকি মুক্তিযোদ্ধার নায়ক বঙ্গবন্ধুর মূর্তি পর্যন্ত ভাঙার চেষ্টা করে বিক্ষুব্ধরা। হাতুড়ি নিয়ে মূর্তির মাথায় উঠে বারংবার আঘাত করে ভাঙার চেষ্টা করে বিক্ষুব্ধ আন্দোেলনকারীরা। নজিরবিহীন এই জনরোষের সমস্ত ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগেই তাঁর বাসভবন, ”গণভবন” ঘিরে ফেলেছিল বিক্ষুব্ধরা। তারপর জনস্রোতের কাছে হার মানে নিরাপত্তা বাহিনী। বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনের অন্দরে ঢুকে ভবনের দখল নিয়ে নেয়। সরাসরি শেখ হাসিনার বেডরুমে ঢুকে তাঁর বিছানায় শুয়ে ”গণভবন আমাদের দখলে” বলে হিংসাত্মক উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। শুধু তাই নয়, আওয়ামি লিগের ধানমুণ্ডির কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওই এলাকাতেই থাকতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদউদজামান খানের বাড়িও ভাঙচুর করা হয়। সোমবার দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে এই দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যায়, ফটক ভেঙে হাজারো আন্দোলনকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় ঢুকে পড়েন। বাড়ির ভিতর থেকে ধোঁয়াও বের হতে দেখা যায়। ভিতরে চলতে থাকে ভাঙচুর। বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতি ওবাইদুল হাসানের ধানমুণ্ডির বাড়ির পাঁচিল টপকে ঢুকে সেখানেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। পাশাপাশি ৩২ নম্বর ধানমুণ্ডি রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত যাদুঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এএফপি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ছাড়ার আগে একটি বক্তৃতা করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি তা করার সুযোগ পাননি।
পড়ুয়াদের বিক্ষোভ-আন্দোলন দমন করতে লাঠি-গুলি-সব অস্ত্রই ব্যবহার করে আওয়ামী লিগ সরকার। আওয়ামি লিগ, ছাত্রলিগ, যুবলিগ–এর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হিংসা এতটাই বেড়ে যায় যে প্রশাসন বাধ্য হয়ে মোবাইল, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং অনির্দিষ্ট সময়রে জন্য দেশব্যাপী কার্ফু জারি করে। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না। গণবিক্ষোভের জেরে শুধু প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়াই নয়, দেশও ছাড়তে হল শেখ হাসিনাকে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিজের বাসভবনে খুন করা হয় সপরিবার শেখ মুজিবর রহমানকে। আর কাকতালীয় ভাবে প্রায় ৫০ বছর পরের এক আগস্টেই দেশ ছাড়তে হল মুজিব-কন্যা হাসিনাকে।
বাংলাদেশ রাজনীতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, পড়ুয়াদের আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নতুন করে ছাত্রবিক্ষোভ এবং হিংসা ছড়িয়ে পড়ায় মাত্র তিন দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হল হাসিনাকে। সোমবার পর্যন্ত ১৩ দিনে সারা দেশে দশ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সোমবারেই গ্রেফতার হয়েছেন ৪০৩ জন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোয় নাজমা আক্তার নামে সংগঠনের এক নেত্রী বলেন, এটা লজ্জার যে হাসিনা ঢাকা ছেড়ে গেলেন ভয়ে। সম্মিলিত গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নাজমা বলেন, উনি আমাদের দেশটাকে হত্যা করেছেন। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন। আমাদের মানুষকে হত্যা করেছেন। হাসিনা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন না। উনি শুধু এখান থেকে ফায়দা লুটেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে গেলেন।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা , চর্চা শুরু হয়েছে। হাসিনার পুত্র সাজিদ ওয়াজিদ জয় একট সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁর মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। এত পরিশ্রমের পরও যেভআবে তাঁর বিরপদ্ধে আন্দোলন হল, তাতে তিনি অত্যন্ত হতাশ ও বিরক্ত। সোমবার পদত্যাগের পর এক সংবাদমাধ্যমে তিনি তিনি বলেন, রবিবার থেকেই পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন হাসিনা। শেষ পর্য়ন্ত পরিবারের চাপে এবং নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ছেড়েছেন তিনি। সাজিদ বলেন, উনি বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। উনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন দেশের করণ অবস্থা ছিল। বাংলাদেশ গরিব দেশ ছিল। আজ বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ। উনি খব হতাশ। ‘