দিল্লি, ২২ মে– মোদি জমানায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব হয়েছে৷ এখানে জোর গলায় কেন্দ্রবিরোধী বা শাসকদল বিরোধী খবরে যে কোনও পদ্ধতিতে কাঁচি চালিয়েছে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি৷ এমনটাই বলছে একটি দুটি নয়, বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি সমীক্ষা রিপোর্ট৷
সিএনএন ওয়ার্ল্ড-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি সমীক্ষা রিপোর্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন জনসভায় তাঁর আমলে দেশের উন্নয়ন নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ আর তা ফলাও করে প্রকাশ হচ্ছে টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজগুলিতে৷ কিন্ত্ত, গত ১০ বছরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের মুক্তকণ্ঠকে কবরে পাঠানো হয়েছে৷ ভারতের সরকার জনপ্রিয় নেতার দ্বারা পরিচালিত হলেও তিনি বিভাজনবাদী৷ প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার পর থেকে গত ১০ বছরে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি৷ বিরোধীদের লাগাতর অভিযোগ, গণমাধ্যমের বহুত্ববাদকে দমন করে রেখেছেন৷ এবং বিরোধী কণ্ঠের সাংবাদিকদের উপর দেশদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এসব অভিযোগে তাঁদের মুখ বন্ধ করা হয়েছে৷
মোদি জমানায় সাংবাদিকতার কি হাল তার উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে সিদ্দিক কাপ্পানের কথা৷ সিএনএনকে কাপ্পান বলেছেন, এখন কোনও কিছু লেখার আগে কয়েকশো বার ভাবি, যে কোনও সময়, দেশের যে কোনও প্রান্তে, যে কেউ আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে৷ এই ভয় ও আতঙ্কের কালো মেঘ ছডি়য়ে রয়েছে ভারতের গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের উপরে৷ ২০২০ সালে হাথরাস কাণ্ডের প্রথম সংবাদ প্রকাশের জন্য সিদ্দিক কাপ্পানকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে অর্থ তছরুপের অভিযোগে ২৮ মাস জেল খাটতে হয়েছিল৷ কাপ্পানের এই অবস্থা দেখে সাংবাদিক মহলে একটা হাড়হিম করা আতঙ্কের চোরাস্রোত বয়ে চলেছে৷ সবাই নিজেকে সরকারের নেকনজরে রাখার চেষ্টায় রয়েছে৷ কৌশিক রাজ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থায় লেখালেখি করেন৷ তাঁর বিষয় হচ্ছে ঘৃণা-বিদ্বেষজনিত অপরাধ৷ কৌশিক জানালেন, কাপ্পানের কথা ভেবে আমিও ভয়ে আছি৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম-এর ২০২৩ সালের মানকাঠিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১ নম্বরে৷ এই অবনমন ঘটেছে ২০১৪ সালে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের পর থেকে৷ এই তালিকায় ভারতের উপরে রয়েছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানও৷ শুধু প্রতিবেশী বাংলাদেশ ভারতের পিছনে রয়েছে৷
ভারত হল মিডিয়া বাজারের অন্যতম বৃহৎ দেশ৷ প্যারিসস্থিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে কমবেশি ২০ হাজার দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়৷ এবং ৪৫০টি বেসরকারি মালিকানার চ্যানেল রয়েছে৷ বহুভাষিক ও স্থানীয় চ্যানেলও শুধু সংবাদ উপস্থাপন করে এমনও গণমাধ্যম রয়েছে ভারতে৷ তা সত্ত্বেও সমালোচক ও মিডিয়া গবেষকদের মতে, এত বড় সংবাদ জগৎ হওয়া সত্ত্বেও ভারতে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি দিনদিন দ্রুত গতিতে মোদী সরকারের পরাধীন হয়ে চলেছে৷ লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের মিডিয়া, কালচার এবং সোশ্যাল চেঞ্জ বিষয়ের অধ্যাপক শকুন্তলা বানাজির মতে, ভারতের সংবাদ জগতে সরকারি পরিষেবা, জনস্বার্থ এবং বেসরকারি কর্পোরেট মিডিয়ার একটা মিশেল রয়েছে৷ তাদের সব কিছু আছে৷
বিবিসির দফতরে আয়কর অভিযানের কথা তো সবাই জানেন৷ এই অবস্থায় অনেকের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে রয়েছে, মোদী ফের ক্ষমতায় এলে কী হবে? আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলিক মালিকানা আপাতত মোদী-শাহ ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কবজায়৷ তাই কার্যত সরকারপোষিত গণমাধ্যমের স্বাধীন কাজ করা এই অবস্থায় প্রায় অসম্ভব৷
প্যারিসের ওই সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতের সংবাদ জগতে স্বাধীনতার মান ২৫টি দেশের নীচে চলে গিয়েছে৷ সিপিজে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছে, ২০০৪-২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৭ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল৷ ২০১৪-২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ২১ সাংবাদিক৷ বিশেষত সন্ত্রাস দমন আইনে সরকার ১৮০ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকদের আটক রাখার ক্ষমতা অর্জন করায় সেই আতঙ্ক আরও বেডে়ছে৷ ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক রভীশ কুমার বলেন, অনেক বছর ধরেই তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না৷ কারণ, বিভিন্ন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন তাঁকে অনবরত হেনস্তা এমনকী খুনের ভয় দেখিয়ে চলেছে৷
সম্প্রতি অস্ট্রেলীয় ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দক্ষিণ এশিয়া বু্যরো চিফ অবনী ডায়াসকে ভারত ছাড়তে হয়েছে৷ যেমনটা হয়েছে, ভ্যানেসা ডগনাককে৷ তিনি চারটি ফরাসি প্রকাশনা সংস্থার ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন৷ ডায়াসকে বলা হয়েছিল, তাঁর ভিসার মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না৷ কারণ তিনি সীমা অতিক্রম করে ভারত বিরোধী খবর লিখছেন৷ ২৩ বছর ভারতে সাংবাদিকতা করা ডগনাককেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি ভারতের উপরে নেতিবাচক কথাবার্তা লিখতেন বলে অভিযোগ৷ তাঁরও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করেনি অমিত শাহের মন্ত্রক৷