সুদর্শন নন্দী
বিদেশ ভ্রমণের গোপন সখটি ছিল আকৈশোর ৷ আর সেই ষোল বছর বয়সের সখ মিটল ষাটে৷ বিজ্ঞাপনী মোড়কে বললে ‘ড্রিম অফ সিক্সটিন, রিয়েলিটি অ্যাট সিক্সটি’ বলা যেতে পারে৷ স্ত্রী মেয়ে জামাই নাতনি সবাইকে নিয়ে যাব বিদেশে, ইউরোপে৷ তবে যাব বললেই তো আর যাওয়া হয় না, তাও আবার বিদেশ ভ্রমণ বলে কথা৷ প্রথমে দরকার বিশ্বস্ত টু্যর সংস্থা৷ তারপর টাকা পয়সা বাদ দিলেও পাসপোর্ট, ভিসা, ইনসুরেন্স, অফিসের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট এসবের ঝামেলা৷ এরপর বয়সে ভ্রমণে গেলে পদে পদে বাড়তি হোঁচট৷ হার্ট থেকে হাঁটু বেগড়বাই করলে তীরে এসেও তরী ডুবতে পারে৷
সব ঝামেলা সামলে বিদেশ ভ্রমণ কম ঝক্কির নয়৷ তবে সব ঝামেলায় গোল দিয়ে জিতে গেলে বিদেশে পা দেবার পর যে সে কি রোমাঞ্চ তা বলে বোঝানো যাবে না৷ ইচ্ছে হবে গলা খুলে গাই – এলেম নতুন দেশে–তা বিদেশ যাবার নেশা চাগাড় দিয়ে উঠতেই হেইয়ো বলে জোরসে শুরু করলাম প্রস্তুতি৷ কেন্দ্রিয় সরকারের চাকর৷ চাকরি বাঁচাতে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি আগে নিতে হবে৷ আমার আবার টিকি বাঁধা দিল্লীতে৷ সেখান থেকে ভিজিল্যান্স ক্লিয়ারেন্স পেলে কলকাতা অফিস থেকে পাব অনুমতি পত্র৷ তা দরখাস্ত করতেই সবার চোখ আমার উপর৷ কাজের সূত্রে বসের সাথে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না আমার৷ আদা-কাঁচকলার আগের স্টেজ l ফলে বিদেশ যাবার দরখাস্ত পেয়ে দ্বেষ উগরে দিলেন৷ বললেন- ছুটি পাবেন না৷ অন্য সময় যান৷ পাশে বসেছিলেন দত্ত সাহেব৷ কারো ভালো দেখতে পারেন না এই দত্ত৷ শুধু গত্ত খুঁজে বেড়ান সবার৷ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন৷ এতো খরচ, ম্যানেজ করবে কিভাবে? প্রশ্ন শুনে রাগ হলেও দশ থেকে এক গুনলাম মনে মনে৷ একটু ধীর স্থির হয়ে বললাম, পিপিএফের আজীবন জমানো টাকার সবটাই প্রায় তুলে নিচ্ছি৷ দত্ত সাহেব চুপ৷ আমার অফিসার বললেন, ওসব বিদেশ টিদেশ পরে হবে- সামনের সপ্তাহে দিল্লীর মিটিং৷ সব ডাটা তৈরি করুন কালকের মধ্যে৷
অতএব বিদেশ বেড়ানোর দরখাস্ত শিকেতে তুলে অফিসের কাজে লেগে গেলাম৷ কপাল ভাল, আঞ্চলিক কর্তার কানে আমার ভ্রমণের ব্যাপারটা আগেই জানিয়ে রাখায় দেরি হলেও অনুমতি পত্র পেয়ে গেলাম৷ এরই মাঝে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখা শুরু করেছি পেপারে, ম্যাগাজিনে৷ এক বহু পুরানো বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপনী-ছিপের বড়শিতে গিললাম টোপ৷ যাব সস্ত্রীক- সকন্যা-জামাই নাতি পাঁচ জন৷ তাঁরা এই দশাশই বোয়াল মাছ ছাড়বে কেন? তাঁরা ফেব্রুয়ারির শেষে আমন্ত্রণ করলেন রুবির সন্নিকটে গেটওয়ে হোটেলে তাদের এক কনফারেন্সে৷ খুঁতখুঁতে মানুষ আমি৷ সলতে পাকাতে গিয়ে প্রদীপ ভেঙ্গে ফেলি৷ জামাইরাজা বললে- ডোন্ট ওরি বাবা, পাকা হাতে আমি সলতে এমন পাকাব যে বিনা তেলেও জ্বলতে থাকবে ৷ নিশ্চিন্ত হয়ে ভার লাঘব করি তার ঘাড়ে সব চাপিয়ে৷
বেশ পাকা হাতেই সে ওদের সাথে ম্যাক্সিমাম ডিসকাউন্ট আদায় করে টু্যর ফাইনাল করল৷ ইউরোপের ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি আর সুইজারল্যান্ড এই পাঁচ দেশ ঘুরব নয় দিনে (পরে যা পনের দিনে নটি দেশ হয়)৷ সব ঠিক হবার পর তারা তাদের অফিসে যেতে বললেন বিস্তারিত জানতে ও ভিসার ব্যাপারে৷ সেসব সাঙ্গ হল৷ আমার অফিসের নো অবজেকশন মিলেছে৷ সেই হোঁচটও পেরিয়েছি৷ হল দুটি ভিসার (একটি ইংল্যান্ড ও অন্যটি সেঞ্জেন ভিসা) কাজকর্মও৷ বললাম বটে সাঙ্গ হল ভিসার কাজ৷ তবে তা কম ঝক্কির নয়৷ কসবার রেনে টাওয়ার বিল্ডিংএর ঝাঁ চকচকে ভিসা অফিসে ভিসার ইন্টারভিউ সেও কম টেনশেনের নয়৷ ভিসার ডকুমেন্টেশন হল মূল চালিকা শক্তি৷ হাজারবার চেক করেও ভুল না থেকে যায়৷ আমাদের আবার চোখে চালসে৷ বয়স আলসে৷ নয়কে ছয় দেখি, সব উলটপালট হয়ে যায় প্রয়োজনের সময়৷
ভিসার ইন্টারভিউয়ের পর ইউরো, ডলার নেওয়া থেকে হিসেবে সড়গড় হওয়া এসব টাস্কও শেষ, যদিও মাঝে মাঝেই পেনি-সেন্ট গুলিয়ে যায়৷ অন্যান্য ফরমালিটিস শেষ হলে অপেক্ষা করতে লাগলাম ভিসা আর যাবার দিনটি কত তাড়াতাড়ি আসবে সেজন্য৷ কপাল বা ভাগ্যকে বিশ্বাস না করলেও এ ঘটনা আমাকে নাস্তিক থেকে আস্তিকে বদলে দিল৷ সব যখন অন ইওর মার্ক; বাঁধাবাঁধি গোছানো বাগানো শেষ, শুধু বেরব আর একদিন পর, তখন টু্যর সংস্থা থেকে ফোন এল টু্যর আপাতত বাতিল৷ কারণ সাইবার অ্যাটাকের দরুন সবার ভিসা নাকি পাওয়া যায় নি৷ শরীর বেয়ে সুনামি খেলে গেল৷ কয়েকলাখ টাকা টু্যর সংস্থাকে দিয়ে দিয়েছি৷ সেই কয়েক লাখ টাকা হাপিজ করার কায়দা নয়তো এটা?
জামাই জামা খুলে পেশি ফুলিয়ে বলল, ওরা সলতেটাকে জ্বলতে দিল না, জল ঢালার ফল টের পাবে হাড়ে হাড়ে৷ এসপার ওসপার করে ছাড়ব৷ এদিকে সব প্রস্তুতি শেষ, টু্যর পিছলেও নতুন করে ছুটি পাওয়া, এন ও সি জোগাড় সম্ভবই নয়৷ বিষাদের রাহু ভ্রমন-আনন্দকে গ্রাস করল৷ সংস্থার বোম্বের কর্পোরেট অফিসে কমপ্লেন ঠুকলাম৷ তাতে ভয় দেখানোর প্রচ্ছন্ন আভাস দিলাম ছুঁইয়ে৷ ঘণ্টা খানেক পর ফোন এল কলকাতার অফিসের ম্যানেজারের৷ বললেন, আমরা তো আছি৷ আবার মুম্বই অফিসে বললেন কেন? সমস্যাটা প্র্যাকটিক্যালি বুঝবেন তো? বললাম সমস্যাটা আপনি বুঝুন৷ এ সপ্তাহে না রওনা দিলে আদালতে দেখা হবে৷ ম্যানেজার বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন টু্যর হবেই এবং আগের থেকে ভালো হবে৷ কনফিউসড কথাবার্তা৷ এদিকে ঘুমের জন্য এলজোলাম ডবল করেছি৷ প্রেসার যন্ত্র বালিশের পাশেই রাখি৷ কিন্ত্ত রাখে হরি মারে কে৷ ওরা সামান্য বাড়তি টাকা চেয়ে নটি দেশের নতুন একটি টু্যরে আমাদের সেট করে দিল৷ ইউরোপের ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি আর সুইজারল্যান্ড এই পাঁচ দেশ ছাড়াও দেখাবে বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া আর জার্মানি৷ ইতালিতে পোপের ভ্যাটিকেন সিটি এই ছোট্ট দেশটি ধরলে নটি দেশ পনের দিনের টু্যরে৷ বাকি টাকা দিয়ে আর অফিসের ঝামেলা চুকিয়ে আবার যাবার দিন গোনা অপেক্ষা এবং আবার শেষমেশ বাতিলের খবর আসে কিনা সেজন্য শেষ দুরাত্রি নিদ্রাহীন৷
শিশির বিন্দু দেখেছি, এবার সিন্ধু দর্শনে যাবার পালা৷ হিসেবমতো ওজন করে ব্যাগ গুছানো হয়েছে৷ সংস্থার সংশ্লিষ্ট অফিসারটি বারবার বলেছেন আপনি হারিয়ে যান ক্ষতি নেই, আপনার শরীরের অঙ্গ হারিয়ে গেলেও অসুবিধা নেই, কিন্ত্ত ভিসার ছাপ মারা পাসপোর্টগুলি না হারায় সেদিকে একমাত্র খেয়াল রাখবেন৷ একটি ছোট ব্যাগে সেসব বেঁধে পেটের সামনে রেখে আঁকড়ে ধরে আছি প্রসূতির হবু সন্তান স্নেহের মতো৷ ক্যাব ওলা আসতেই ঝোলা নিয়ে বের হই দশ পায়ে পাঁচ জনে ৷ ট্যাক্সিতে চেপে বড় রাস্তায় উঠেছি বউ বললে, আমরা একদিন আগে এয়ারপোর্ট যাচ্ছি না তো? রাত বারোটার পর ট্রেন বা প্লেন ধরার এক সমস্যা তারিখ নিয়ে৷ বারো তারিখে বারোটা এক মিনিট মানে এগার তারিখের সন্ধ্যার পর যে রাত সেটি ৷ ড্রাইভার বৌ-এর কথা শুনে গাড়ি স্লো করল৷ মেয়ে বললে ভুল হলেও রাতে দমদমে হোটেলে কাটাব, আর দশটা চাবি খুলে ঘর ঢুকছি না৷ টিকিট বের করে হিসেব করে জামাই কনফিডেন্টলি বললে, ড্রাইভার সাব, জোরে এক্সিলেটর চাপো দেখি৷ পৌঁছে গেলাম দমদমে৷ কাতার এয়ারলাইন্সের বিমানে যাব রাত ২-৪০ মিনিটে৷ প্রথমে দোহা, তারপর সেখান থেকে আবার বিমান চেঞ্জ করে লন্ডনের হিথরো৷ টক ঝাল মিষ্টি পর্ব শেষে হিথরোতে নামলাম যথাসময়ে৷ দ্বেষ বিদ্বেষ কাটিয়ে জীবনের প্রথম বিদেশ সফর৷