• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

ন্যাওড়া ভ্যালির রূপ 

পার্থময় চট্টোপাধ্যায় আমি ভ্রমণ রোগে আক্রান্ত হয়েছি আজ থেকে ৪৩ বছর আগে, দিনটা ছিল ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে। বাংলার বাইরে প্রথম পা রেখেছিলাম একেবারে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে । সেই থেকে এই ভ্রমণ রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে । ৪৩ বছর ধরে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। সারা দেশ ঘুরে দেখেছি… দেখেছি সেই ভাবে পর্যটনের উন্নয়ন নিয়ে সরকারি প্রশাসন

পার্থময় চট্টোপাধ্যায়
আমি ভ্রমণ রোগে আক্রান্ত হয়েছি আজ থেকে ৪৩ বছর আগে, দিনটা ছিল ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে। বাংলার বাইরে প্রথম পা রেখেছিলাম একেবারে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে । সেই থেকে এই ভ্রমণ রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে । ৪৩ বছর ধরে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। সারা দেশ ঘুরে দেখেছি… দেখেছি সেই ভাবে পর্যটনের উন্নয়ন নিয়ে সরকারি প্রশাসন তেমন ভাবে ভাবেনি। ব্যক্তিগত মালিকানার কিছু কিছু উন্নয়ন হয়েছে পর্যটকদের টানার জন্য। যখন সারা পৃথিবীর দেশ গুলো পর্যটনকে একটা শিল্পের গুরুত্ব দিচ্ছিলো তখনও আমরা পর্যটনকে অবহেলা করে রেখেছিলাম। আমাদের দেশে মরুভূমি, সমুদ্র, জঙ্গল, পাহাড়, ঝর্ণা ও নদনদী সবই আছে, বছরে ভারতবর্ষে বিদেশী পর্যটক আসে কয়েক লক্ষ। বিদেশী মুদ্রা আসে।
আমার বাংলায় আছে মরুভূমি বাদে বাকি সব।
বিগত দশ বছরে পশ্চিমবাংলার পর্যটন শিল্পের বেশ অনেকটাই উন্নয়ন হয়েছে। দীঘা, মন্দারমণি, মুকুটমণিপুর, বকখালি, বিষ্ণুপুর, বীরভূম, হুগলী চন্দননগর,মুর্শিদাবাদ নলহাটি তারাপীঠ, কঙ্কালী তলার , পুরুলিয়া যা চেহারা ছিল তা আজ দেখলে গর্ব হবে যে আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসি এই রাজ্য আমারদের। পাহাড়েও অনেক উন্নয়ন হয়েছে বিশেষ করে দার্জিলিং, কালিম্পঙ কার্শিয়াং শহর কেন্দ্রিক জায়গাগুলো।
রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে, বিদ্যুৎ পরিষেবা, পানিও জল, এই সব পরিষেবা পাহাড়ি শহর গুলোতে হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি গ্রামগুলি এখনো বঞ্চিত, ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোমস্টে মালিকরা উন্নয়নে চেষ্টা করলেও তা খুবই ব্যয় বহুল বিশেষ করে বিদ্যুৎ লাইন ও জলের লাইন আনতে এদের চোদ্দবার ভাবতে হয়।এবার চলেছি ন্যাওড়া ভ্যালির অনুসন্ধানে, ১৯৮৬ সালে এই পাহাড়ি বিস্তীর্ণ বনভূমিকে সরকার জাতীয় উদ্যানের সম্মান দিয়েছিলো, এই ঘোষণায় সে কি পেলো , কি উন্নয়ন হলো এইটা দেখে আসি… 

আমার গন্তব্য রিশপ, লাভা, কোলাখাম আর ঝান্ডি। মালবাজার স্টেশন থেকে বোলেরো গাড়ি ভাড়া করে গরুবাথান হয়ে লাভা পৌঁছনো যায় দেড় ঘন্টায় ৬০ কি মি এর মতো পথ, এই পথের সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা যায়না, মেটালি, সোমবারে হাট, ফাগু হয়ে আম্বেযক টি গার্ডেন আর সামাবিয়ং টি গার্ডেন্স দেখতে দেখতে লাভা বাজার পৌঁছানো যায়। এখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে কোলাখাম। আজ ডেরা বাঁধবো রিশপে। লাভা থেকে আরও ১২ কিলোমিটার পেরিয়ে দুপুর ১২টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম রিশপ। এটা হচ্ছে কালিম্পঙ জেলার সব থেকে উঁচু একটা হিলস্টেশন । শুধুই হোমস্টে আর হোটেল, সাধারণ ঘরবাড়ি খুব একটা নেই। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক, একদম পরিষ্কার আকাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘা একদম পরিষ্কার ভাবে জেগে আছে। টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রায় ২০০ কিলোমিটার বিস্তৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে। ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এই ভিউ পাওয়া যায়, নাথুলা পাস্ দেখা যায়। কাঞ্চন, কাব্রু , পান্ডিম সিনিয়ালচু সহ আরও গোটা বিশেক দেশি ও বিদেশী চুড়ো দেখা যায়, বিশ্বের উচ্ছতম পাহাড় হিমালয়ের রেঞ্জকে। রিশপের সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখলে জীবন স্বার্থক। লাভা থেকে রিশপ যাবার রাস্তাটা ভীষণ রোমাঞ্চকর , ঘন পাইন বনের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা দিনের বেলায় গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে যেতে হয়, এতো ঘন এই ন্যাওড়া ভ্যালি জঙ্গল।

ছবির মতো সুন্দর আর বরফের মতো শান্ত এই রিশপ। ফুল আর পাখিদের আবাদ ভূমি এই রিশপ। চলতে চলতে দেখতে পাবেন… ফ্ল্যাই ক্যাচার… ভার্ডিটার ফ্ল্যাইক্যাচার, রুফাস সিবিয়া, গ্রিন ব্যাকেট টিট সুন্দর সুন্দর পাখিদের। পেডং মাত্র ২২ কিলোমিটার , কালিম্পঙ ৩৫ কিলোমিটার আর কাছের শহর বলতে লাভা, লোলেগাঁও এখান থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার হবে। লোলেগাঁও আমার দেখা, তাই আমরা দুদিন রেশপে থেকে এখান থেকে চলে যাবো কোলাখাম।

পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় উচ্ছতম একটা পর্যটন কেন্দ্র এই রিশপ , যার রূপের বৃস্তৃতি সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে, কিন্তু সেই জায়গাটি সরকারি প্রশাসনের কাছে অবহেলিত, সরকারের এই সুন্দর জায়গাটিকে ন্যূনতম পরিষেবা দেওয়া উচিত নয়কি! নেই কোনো বিদ্যুতের পূর্ণ পরিষেবা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খুবই খারাপ, পানিও জল ও স্নানের জলের তীব্র সংকট হয় এখনো এক এক সময়। কালিম্পঙ জেলার সম্মান পেয়েছে ৭ বছর আগেই , ১৪ ফেব্রেয়ারি ২০১৭ সালে জেলা ঘোষিত হলো, কিন্তু এখনো লোলেগাঁও, কাফেরগাও, পাবঙ্গ, রিশপ, পেডং, কোলাখাম সহ গরুবাথানের পর্যটন কেদ্রগুলি অবহেলিত।

রিশপের দ্বিতীয়দিন গেলাম ৪০ কিলোমিটার দূরের নখধারা লেক দেখতে, পাহাড়ে ঘেরা এক অপরূপ লেক, মুগ্ধ হতে হবে এর রূপ দেখে, লাভা পেরিয়ে দেখে এলাম, ফেরার সময় লাভা মনাস্ট্রিতে বসে পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের ঘর বানানো দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামতে দেখলাম, এবার উঠবো রিশপের পথে চলবো…
পূর্ণিমা রাত্রে নাকি এই পথে পরীদের দেখা যায়, ঘন পাইন জঙ্গলে গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে চাঁদের আলো এমন ভাবে পড়ে যে দেখলে মনে হয় ডানা খোলা পরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। রিশপে হোমস্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি সত্যি রাত্রিহত হলাম যেন । সামনে পেছনে পাহাড়ের গায়ে কে আলোর মালায় সাজিয়ে রেখেছে! পরদিন খুব ভোরে সাতরঙা সূর্যোদয় দেখে রিশপের সব রূপটাকে যেন নিঙড়ে নিলাম।

তৃতীয়দিন ব্রেকফাস্ট করে চললাম কোলাখামের  পথে। লাভা থেকে খাবার জলের একটা ক্রেট গাড়িতে তুলে নিলাম কারণ রিশপে জলের সমস্যা হয়ে ছিল।
লাভা বাজার থেকে অর্ধ কাঁচা রাস্তা ধরে দুলতে দুলতে চলেছি কোলাখাম। এটাও নাওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান। ঘন জঙ্গল, এখানে নাকি ব্ল্যাক পান্থার দেখা যায়! তবে না দেখাই ভালো কারণ এরা নাকি ভীষণ হিংস্র ও চতুর, কোথা থেকে কখন আক্রমণ করে তা বোঝা যায়না।

সকাল ১১টা , কোলাখাম যেন ঘুমিয়ে , রাস্তার দুই ধারে শুধুই হোমস্টে। গাড়ি থামলো অতিথি আর আরোহীদের সামনে , বিকাশ রাই আমাদের অপেক্ষায় ছিল। গাড়ি থেকে নেমে চোখে পড়লো সাদা সাদা ছোট বড়ো কিছু পাহাড়ের চুড়ো। শুনেছি কোলাখামে ভোলামনে ছাঙ্গে যাওয়া আর খোলাচোখে কাঞ্চনজংঘা দেখতে হয়। দুপুরের খাবার খেয়ে চললাম ছাঙ্গে ফলস দেখতে, এখানে এক অদ্ভুত নিয়ম চালু আছে এখানকার গাড়ি সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে… কোনো বাইরের গাড়িতে ছাঙ্গে যাওয়া যাবেনা, সিন্ডিকেটের গাড়ি নিতে হবে ,যাতায়াত ১২/১৪ কিলোমিটার সময় ২ ঘন্টা আর ভাড়া ১৫০০ টাকা , এক অদ্ভুত দাদা গিরি যেন । ছাঙ্গের রূপ দেখে সিন্ডিকেটের উপর যে ক্ষোভ জমে ছিল তা যেন ছাঙ্গে ঝর্ণার জলে ধুয়ে গেলো। অনেক উঁচু থেকে জলের ধারা বহু নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। সত্যি এক অপূর্ব রূপ এই ঝর্ণার, পশ্চিমবঙ্গের এটাই হয়তো সব থেকে বোরো ঝর্ণা!

সকালে উঠে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যের আলোয় যেন গায়ে হলুদ হচ্ছে। কি অপুরূপ দৃশ্য, সব কিছু ভালো লাগছে, এই নীরব গ্রামটাকে ভালো লাগছে, এই শান্ত পথঘাট ভালো লাগছে, কুয়াশা মাখা ফুল গুলো ভালো লাগছে, শিশির ভেজা সামনের বাড়ির চাল টাকে ভালো লাগছে, পাইন কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ টাকে ভালো লাগছে আর ভালো লাগছে নিজেকে নিজের ভালো লাগছে… পাহাড়ি ফুলের যদি গন্ধ থাকতো তবে আমিও ভ্রমরের মতো চঞ্চল হতাম কিনা জানিনা!

একদিন মাত্র খোলাচোখে কোলাখামকে দেখে আজ চলেছি গরুবাথানের পথে… আজকের ডেরা হবে ঝান্ডি পাহাড়ের “ইকো হাট” রিসর্টে তারপর কুমাই পাহাড়ের “গোর্খা হোমস্টে”
এবার একজন পর্যটক হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন করবো যে সমতলে যে ভাবে দীঘা, মুকুটমণিপুর, মন্দারমণি, বকখালি, শান্তিনিকেতন সহ সারা বাংলার চেনা জানা পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে সাজিয়েছেন যে ভাবে পথঘাট বিদ্যুৎ, পানীয়জল পরিষেবার উন্নয়ন হয়েছে তার কিছুটা অন্তত পাহাড়ের অফবিট পর্যটক কেন্দ্রগুলোকে পরিষেবা দিন। লোলেগাঁও পবঙ্গ, রিশপ, কোলাখাম, পেডং, কুমাই, ঝান্ডি , ছিবো এই সব ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম গুলোকে পর্যটনের পরিকাঠামো দিয়ে পাহাড়ি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যায় , বেকারত্ব দূর করা যায়। শুধু সুন্দর নিয়োন বাতিতে লেখা “আই লাভ ইউ … ” দিলেই উন্নয়ন হয়না, গভীরে ঢুকে প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা কি সেটাকে দিতে হয়।

কি ভাবে যাবেন ….
রিশপ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১১৫ কিলোমিটার গাড়ি ভাড়া ৫০০০ ত্বককে সময় নেবে প্রায় ৫ ঘন্টা।
আবার শিয়ালদাহ থেকে কাঞ্চনকন্যা ট্রেনে নিউ মালবাজার নেমে গাড়িতে আড়াই ঘন্টার মধ্যে রিশপ পৌঁছানো যায়, ভাড়া ৩৫০০ টাকা ৬৫ কিলোমিটার পথ।

থাকার প্রচুর হোটেল ও হোমস্টে আছে হোটেলে থাকা দুজনের ঘর ১৫০০ থেকে শুরু খাওয়া আলাদা খরচ আর হোমস্টে তে ১২০০ টাকা একজনের একদিনের থাকা ও খাওয়া ।
সেপ্টেম্বর শেষ থেকে মে মাস এই জায়গায় যাওয়ার আদর্শ সময়।