• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

বিশেষজ্ঞদের মতে কেদারনাথের চোরাবাড়িতে হিমবাহের নুড়িপাথর আস্তরণ খনন বিপজ্জনক

কেদারনাথ পুনর্গঠন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ঠিকেদার সংস্থাগুলি যেভাবে চোরাবাড়ি হিমবাহ থেকে ক্রমাগত নুড়িপাথরের আস্তরণ খনন করছে, তা কেদারপুরী শহরের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা ৷

বিশেষ প্রতিনিধি

কেদারনাথ পুনর্গঠন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ঠিকেদার সংস্থাগুলি যেভাবে চোরাবাড়ি হিমবাহ থেকে ক্রমাগত নুড়িপাথরের আস্তরণ খনন করছে, তা কেদারপুরী শহরের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা ৷

ভূতাত্ত্বিক, হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানুষেরা অভিযোগ করেছেন যে, এই অপ্রত্যাশিত নুড়িপাথরের স্তর অপসারণ ভবিষ্যতে হিমবাহের ফাটল বৃদ্ধি, ভাঙন, গলন এবং ঘন ঘন তুষারধ্বসের পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

২০১৩ সালের মেঘভাঙা বৃষ্টি বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত কেদারপুরী বা কেদারনাথ শহরের পুনর্নির্মাণে নিয়োজিত নির্মাণ সংস্থাগুলি মন্দির এলাকা থেকে ২-৩ কিলোমিটার উপরে চোরাবাড়ি হ্রদ এলাকা থেকে নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে এই নুড়িপাথর খনন করে চলেছে৷ কেদারনাথ সংস্লিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে নিবিড়ভাবে সমীক্ষা করা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই খনন অচিরেই নুড়িপাথর স্তরের নীচে থাকা হিমবাহের ভর উন্মোচন করে দেবে, ফলে ঘন ঘন তুষারধ্বসের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

তাছাড়াও এই হিমবাহের নুড়িপাথর আস্তরণ খননের ফলে হিমবাহের গলন বৃদ্ধি পাবে, ফলে বাহ্যিক প্রদূষণ এবং সৌর বিকিরণের প্রকোপ বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম চললে ২০১৩ সালের হড়কা বানের সম্ভাবনা তুলনায় ৪-৫ গুণ বেশি বৃদ্ধি পাবে। সরকারী নথি অনুসারে, ২০১৩ সালের জুনের দুর্যোগে ৬ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং গোটা কেদারপুরীর অধিকাংশ বাড়িঘরই বন্যায় ভেঙে গিয়েছিল বা ভেসে গিয়েছিল। সেই কেদারপুরীর পুনর্নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে চোরাবাড়ি হ্রদ এলাকা থেকে নির্বিচারে নুড়িপাথরের স্তর অপসারণ করায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে হিমবাহের অংশ। চোরাবাড়ি হিমবাহের উপর থেকে এভাবে নুড়িপাথর আস্তরণ খনন করতে থাকলে তা অবধারিতভাবে দ্রুত বরফের অন্তর্নিহিত ভরকে উন্মুক্ত করে দেবে, ফলে বেড়ে যাবে এর গলনের হার।

এই প্রসঙ্গে শ্রীনগরের এইচএনবি গাড়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রধান এমপিএস বিষ্ট বলেছেন, এর ফলে শুধুমাত্র এই সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ হিমবাহের দ্রুত পতনই ঘটবে না, মন্দাকিনী নদীর উৎসের নিচের এলাকায় একাধিক জায়গায় বরফের একটি বড় অংশের ভাঙন ও বিপর্যয়ও সুনিশ্চিত। সম্প্রতি রামবারা এবং গৌরীকুণ্ডের মধ্যে তৈরি এলাকায় একটি বড় বিপর্যয় দেখা গেছে, যা উচ্চ মন্দাকিনী নদীর গতিপথে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে একাধিক ভূমধ্বসের কারণ হয়ে উঠেছে !

বিষ্ট আরও বলেন, ‘কেদারনাথ শহরটিই এই নুড়িপাথরের স্তরের উপর গড়ে উঠেছে এবং এর ভূসংস্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই শহর যে কোনও গভীর খনন, ব্লাস্টিং, বড় নির্মাণ কাজ এবং উচ্চ ডেসিবেল-যুক্ত কার্যকলাপে ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। কিন্তু এখানে তৈরি কংক্রিটের বাড়িঘরগুলি ইতিমধ্যেই অত্যন্ত সংবেদনশীল বাস্তুসংস্থান এবং প্রাকৃতিকভাবে ও ভৌগোলিক কারণে ভঙ্গুর কাঠামোসম্পন্ন কেদারপুরীর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ফলে ভবিষ্যত বিপর্যয় ২০১৩ সালের থেকে আরও বেশি ভয়ানক হবে’।

একই রকম মতপ্রকাশ করেছেন আরেক সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং অবসরপ্রাপ্ত হিমবাহবিজ্ঞানী ডিপি ডোভাল তাঁর মতে, হিমবাহ এলাকায় নুড়িপাথর খনন করে ওরা আরেকটি বিপর্যয়কে ডেকে আনছে। নির্মাণাধীন শহরে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে যে কোনো সময় মন্দাকিনী নদীতে প্রচুর পরিমাণে জলের স্রোত সৃষ্টি হবে, কারণ হিমবাহটি আরও দ্রুতগতিতে গলে যাবে। এতে কেদারনাথে বড় তুষারধ্বস হতে পারে। ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু তুষারধ্বস দেখা গেছে, কিন্তু কারোর ভ্রূক্ষেপ নেই এদিকে।

দেরাদুন-ভিত্তিক ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান গ্লেসিওলজি থেকে অবসরপ্রাপ্ত এই হিমবাহবিজ্ঞানী ডিপি ডোভাল ২০১৯ সাল পর্যন্ত চোরাবাড়ি হিমবাহ গবেষণা দলের প্রধান ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘কেদারনাথে বড় বড় দালান তৈরি করে পর্যটন অঞ্চল বানিয়ে কোনও লাভ হবে না। এই সব কিছু ২০১৩-র মতো বিপর্যয়ে প্রকৃতির এক ধাক্কায় অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালের দুর্যোগের কারণও ছিল এই কেদারনাথ শহরের ভূখণ্ডের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়া। এরপর দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ভারী নির্মাণকাজ এবং এর সমান্তরাল কার্যকলাপের ফলে এই স্থিতিশীলতা সম্পূর্ণভাবে নড়ে গেছে। ভবিষ্যতে যে কোনও মেঘভাঙা বৃষ্টি ২০১৩ সালের তুলনায় ৪-৫ গুণ বেশি ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনবে!’

ডোভাল আর বলেন যে, কেদারনাথ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ২০১৩ সালের বিপর্যয়ের সময় মন্দিরের চারপাশে জমা হওয়া বড় পাথরগুলি সরিয়ে ভূখণ্ডের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ‘কেদারনাথ পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুসারে একাধিক স্তরে দেয়াল নির্মাণের চেয়ে এই পাথরগুলি মন্দিরের সুরক্ষার জন্য আরও কার্যকরী হতো’।

কেদারনাথ শহরে নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা রাজ্য সরকারের আধিকারিকরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি না হলেও তাঁরা স্বীকার করেছেন যে, বহুতল ভবন নির্মাণ, গভীর খনন, নির্মাণ কাজের জন্য বড় বড় পাথর অপসারণ এবং পাথর ভাঙার ভারী মেশিন দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ ডেসিবেল-সম্পন্ন কাজ করা হয়েছে। গত ১১ বছরে কেদারপুরীতে হিমবাহের কাছাকাছি ক্রাশার এবং অন্যান্য অনুরূপ কাজগুলি স্থানীয় জলবায়ুকে দূষিত করেছে এবং ভূ-সংস্থানগত স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে।

‘কেদারনাথের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত ১০ বছরে বহুবিধ নির্মাণকাজের ফলে কেদারপুরীর ভূতাত্ত্বিক পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে কেদারনাথ ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার মুখে পড়বে। উন্নয়নের নামে এই দীর্ঘস্থায়ী নির্মাণপ্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যেই পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।

কেদারনাথ চারধাম যাত্রার সভাপতি এবং কেদার সভার সদস্য সন্তোষ ত্রিবেদী বলেন, ‘আজ, নির্মাণ সংস্থাগুলি চোরাবাড়ি হিমবাহ থেকে সমস্ত নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসছে। সরকার এমন সব বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে যা মন্দিরের উচ্চতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। মানুষ আর অতীতের মতো দূর থেকে মন্দিরের চূড়া দেখতে পাচ্ছে না। এভাবে হিমবাহের নুড়িপাথর আস্তরণ খনন চললে কেদারনাথ পুনর্নির্মাণের কাজ কখনই শেষ হবে না’।

২০২৪ সালে কেদারনাথ শহর পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা এই ছয় মাস আগেও নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং (NIM)-এর প্রস্তাবমতো তীর্থযাত্রার একটি বিকল্প পথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এবং তাঁর নেতৃত্বে কেদারপুরীর জন্য একটি নির্মাণ পরিকল্পনা কার্যকর করার পরে এই প্রকল্প গতি পেয়েছে। বদ্রীনাথ কেদারনাথ মন্দির কমিটির (বিকেটিসি) একজন পুরোহিত এবং সদস্য জানান, প্রায় ৩০টি ভবন নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ১০০টিরও বেশি নির্মাণাধীন রয়েছে।