ইস্তেহারের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি করে দেখাব : রাহুল

নির্বাচনী ইস্তেহার হাতে রাহুল গান্ধি ও সোনিয়া গান্ধি (Photo: IANS)

দিল্লি – ২০১৪ সালের ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, জিতলে সব নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কারও অ্যাকাউন্টেই তিনি ফুটো পয়সাটাই পাঠাননি। পরন্তু নোট বাতিল করে গোটা দেশের এক ব্যাপক অংশের মানুষকে পথে বসিয়েছেন। এহেন মোদি এবারও ভোট-ময়দানে অবতীর্ণ আরও হাজার গণ্ডা প্রতিশ্রুতির ঝুলি নিয়ে। জিতে ক্ষমতায় এলে করে দেখানোর দায় যেখানে নেই, সেখানে নির্বাচনী যুদ্ধের আসরটা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিশ্রুতি বনাম প্রতিশ্রুতির লড়াই। সেই লড়াইয়ে যে পিছিয়ে থাকতে চান না একটুও, তা ইতিমধ্যেই জানান দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধি। ইতিমধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছেন জিতে ক্ষমতায় এলে ৫ কোটি গরিব পরিবারের প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবেন বছরে ৭২ হাজার টাকা করে। যার নাম দিয়েছেন তিনি ন্যায় প্রকল্প। সেই প্রতিশ্রুতিদানের এক সপ্তাহ পর আজ আনুষ্ঠানিক ইস্তেহার প্রকাশ করে রাহুল গান্ধি তার সঙ্গে যুক্ত করলেন আরও বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি। তার মধ্যে রয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে ২২ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ, কৃষকদের জন্য পৃথক বাজেট, এনআরসি তুলে দেওয়া, জিডিপি’র ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করার মতো ঘোষণা।

একদিকে প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে তা পালন না করা এইসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত ভোটাররা ভোট দেওয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সব ব্যাপারটা আর এখন তেমন গুরুত্ব দেন না। আর সে কথা বুঝেই আজ ইস্তেহার প্রকাশ করে রাহুল গান্ধি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার সবক’টি তিনি করে দেখাবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। তাঁর ভাষায়, আমারা সেটুকুই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যেটা সত্যি পালন করতে পারবো।

নির্বাচনী ইস্তেহারে নতুন যে চমক দিয়েছন রাহুল গান্ধি, তাঁর মধ্যে সবার ওপরেই রয়েছে কৃষকদের জন্য আলাদা বাজেট। মোদী সরকারের আগের আমলের রেল বাজেটের মতো পৃথক ভাবে কৃষি-বাজেট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল।


২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তেহার প্রকাশ করে রাহুল বলেন, ‘এই ইস্তেহারে মাহুশের চাহিদাকে স্থান দেওয়া হয়েছে’। উল্লেখ্য, আগেই ন্যায় প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল রাহুল। বলেছেন, ‘কংগ্রেস ক্ষমতায় আসা মাত্রই এই প্রকল্প চালু করা হবে। প্রত্যেক গরিব ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে মাসে ছ’হাজার টাকা করে’। তিনি বলেন, ‘এই ইস্তেহার ঘরে বসে তৈরি করা হয়নি। মানুষের চাহিদা, মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে’।

তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনও কৃষক যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা জারি করা হবে না। দেওয়ানি ধারায়ই অভিযোগ হবে। অর্থাৎ তাঁকে জেলে যেতে হবে না। ইস্তেহার প্রকাশের সময় রাহুলের পাশে ছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ইউপিএ চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরন প্রমিখ। রাহুল বলেন, ‘বছর ছয়েক আগে যখন এই ইস্তেহার তৈরির কাজ শুরু করেছিলাম, তখনই জোর দিয়েছিলাম, কোনও অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে না। কারণ এমনিতেই প্রতিদিন আমাদের এত মিথ্যে কথা শুনতে হয়’।

রাহুল তাঁর ইস্তেহারে জোর দিয়েছেন কর্মসংস্থান ও স্বরোজগারের ওপর, যার মাধ্যমে ঘুচে যাবে বেকারত্ব। এজন্য তিনি একদিকে সরাসরি সরকারি চাকরির বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। ৩১ মার্চ ২০২৪ সালের মধ্যে তিনি ২২ লক্ষ সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা দিয়েছেন। চাকরি ছাড়াও স্বনিযুক্ত শিল্পোদ্যোগীকে উৎসাহ জোগাতে রহুলের প্রতিশ্রুতি, ব্যবসা শুরুর প্রথম তিন বছর কোনও সরকারি লাইসেন্স বা অনুমতি লাগবে না।

চাকরিজীবী, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং তামাম মধ্যবিত্তকূলকে খুশি করতে রাহুলের চমক লাগানো প্রতিশ্রুতি, বর্তমান দেশে চালু থাকা পাঁচটি করের বদলে একটি মাত্র কর প্রবর্তন করবে কংগ্রেস, সরকারে এলে। এছাড়া কমানো হবে জিএসটি’র হারও। উল্লেখ্য, নরেন্দ্র মোদির আনা জিএসটি’র ফলে দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।

নাগরিকত্ব বিল নিয়েও বিশেষ আশ্বাস দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল। ক্ষমতায় আসলে অবিলম্বে নাগরিকত্ব বিল প্রত্যাহার করা হবে। অসমের নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশের উত্তর-পূর্বের বাসিন্দারা। তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই এই বিল প্রস্তাব করেছিল বিজেপি সরকার। পাশাপাশি রাহুল বলেছেন, মনরেগা প্রকল্পে একশো দিনের কাজ বাড়িয়ে হবে ১৫০ দিন। জিডিপি’র ছয় শতাংশ ব্যয় করা হবে শিক্ষাখাতে। একই সঙ্গে ইভিএম এবং ভিবিপ্যাটে কারচুপি বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার একদিনের মধ্যে রাফায়েল লেনদেন নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে।

ইস্তেহার প্রকাশের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাহুল বলেন, আমার প্রতিশ্রুতি মতো মদ্ধপ্রদেশ, ছত্তিশগর এবং রাজস্থানে ক্ষমতায় আসার পরেই কৃষিঋণ মকুব করেছি। গোটা দেশের ক্ষেত্রেই তা করা হবে। তিনি বলেন, মোদির রাজত্বে দেশে অর্থনীতির হাল বেহাল, ভারতে এখন সুপার এমের্জেন্সি চলছে। তাঁর আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি যে পুরোটাই ভাঁওতা ছিল, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগই তৈরি করতে পারেনি মোদি সরকার। উলটে জিএসটি আর নোটবন্দি করে প্রচুর মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন না কেন তিনি? কীসের ভয়?’

দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, দুর্নীতি ও বিদেশ নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানালেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধি। কেরলের ওয়ানাড় লোকসভা কেন্দ্র থেকে রাহুল গান্ধির প্রতিদ্বন্দ্বিতার কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদি জনসভায় বলেন, হিন্দু সন্ত্রাসের জন্য তাঁদের পরিবারকে কেন্দ্রের মানুষজন তাঁকে ভোট না দিয়ে শাস্তি দিতে পারেন, সেই ভয় থেকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধি কেরল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পাল্টা জবাবে রাহুল গান্ধি জাতীয় নিরাপত্তা, দুর্নীতি ও বিদেশ নীতি নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিলেন। কংগ্রেসে সভাপতি রাহুল গান্ধি প্রথমবার আমেঠি ও ওয়ানাড় কেন্দ্র থেকে লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তিনি বলেন, ‘আমি ওয়ানাড় আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি তার কারণ, দক্ষিণ ভারতীয়রা মনে করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করেছেন। জাতীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয়দের মতামত গ্রহন করা হয় না। তাই আমি নিজে দক্ষিণ ভারতের জনগণকে বার্তা দিতে চাই যে, কংগ্রেস আপনাদের সাথে রয়েছে’।

প্রধানমন্ত্রী মোদি জনসভায় বলেছিলেন, কংগ্রেস ‘হিন্দু সন্ত্রাস’ পরিভাষা ব্যবহার করে হিন্দুদের অপমান করেছিল। ওদের ভয় আছে, গান্ধি পরিবারের শক্ত ঘাঁটি আমেঠির মানুষজন তাদেরকে ভোট দেবেননা। তাই রাহুল গান্ধি ওয়ানাড় থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওয়ানাড়ে সংখ্যালঘুদের গরিষ্ঠতা রয়েছে’। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাহুল গান্ধি বলেন, ‘চাকরি, মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের মতো ইস্যুগুলোর সমাধান করার বদলে প্রধানমন্ত্রী মোদি তা থেকে পালাচ্ছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন। আপনারা যেভাবে আমাকে প্রশ্ন করছেন ওনাকেও কেন প্রশ্ন করছেন না। কেন তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করতে ভয় পান, ওনাকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনারা রাহুল গান্ধিকে প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু মোদিকে ভয় পান’।