‘নখদন্তহীন’ জাতীয় নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত জেগে উঠে নির্বাচনবিধি ভঙ্গকারীদের কারাের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল।তার আগে কমিশনের দায়দায়িত্ব পালন করার কথা তিরস্কারের ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছিল মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট।আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে হাজির হওয়ারও প্রয়ােজন পড়তে পারে কমিশনের বক্তব্যে তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।
দেশব্যাপী নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুকথা,কুবাক্য,শালীনতাহীন ভাষা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।কমিশনের মেলে নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযােগের পাহাড় জমেছিল।কিন্তু কমিশন অনেকটাই নীরব থেকে,বিধিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,অভিযােগগুলি খতিয়ে দেখে এই কথাই বলে যাচ্ছিল দিনের পর দিন।তারপর সর্বোচ্চ আদালতে এ নিয়ে কেস উঠলে কমিশনের আইনজীবী জানিয়ে দিয়েছিলেন,প্রকৃত প্রস্তাবে কমিশনের হাতে কোনও ক্ষমতাই নেই—কমিশন নখদন্তহীন।
জল যাতে আর বেশি না গড়ায়,কমিশন সম্বন্ধে সর্বোচ্চ আদালতের ভাষা যাতে আরও প্রখর না হয়,তার থেকে রেহাই পেতে,উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী,উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা যােগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে বিধিভঙ্গের শাস্তিস্বরূপ ৭২ ঘণ্টার সময়সীমার মধ্যে প্রচারে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।অতএব একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল কমিশন।বিধিভঙ্গের অভিযােগ ঝুলছে আরও বেশ কয়েকজন বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে।তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি,কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধি।আছেন বাংলার কয়েক নেতা,তাদের মধ্যে অবশ্য পড়েন বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল এবং রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘােষ মহাশয়।প্রশ্ন উঠেছে,প্রধানমন্ত্রী বলেই কি তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?কমিশন অবশ্য বলেছে,না তা কেন?কমিশনের অনুশাসন সবার ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য।প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযােগ খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে।কমিটির রিপাের্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।রাহুল গান্ধির বিরুদ্ধে অভিযােগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আর পশ্চিমবঙ্গের এক তৃণমূল নেতার কথায় তাে কোনও লাগাম নেই।বলে যাচ্ছেন,আর পার পেয়ে যাচ্ছেন।বিজেপি নেতার মুখেও নানা অসংলগ্ন কথার ফুলঝুরি।
নির্বাচনে প্রচারকালে বড় বড় নেতা যাদের কাছ থেকে দেশবাসী ভাল ভাল কথা শুনবেন,জানবেন আশা করেন তারাই অবিশ্রান্তভাবে কুকথার ঝড় বইয়ে দেবেন,আর কমিশন,তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না,তা তাে হতে পারে না। নির্বাচনের ব্যাপারে কমিশনের দায়দায়িত্ব অপরিসীম।তা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা নয়-নেতা ও প্রার্থীরা যাতে ভােটের প্রচারকালে শালীনতার গণ্ডি অতিক্রম করে না যান, তাও দেখা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে তা বন্ধ করা কমিশনের কর্তব্য।
ভােট এলে এইসব বিধিব্যবস্থা নেওয়া থেকে কমিশন এখন বিরত থাকে,তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ টি এন শেসনের কথা আমাদের মনে আসে।তিনিই প্রথম নির্বাচন কমিশনার যিনি কমিশনের স্বাধীনসত্তা,ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি যে কত ব্যাপক তা প্রমাণ করে গেছেন।সুষ্ঠু,শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচন করতে যে ভূমিকা তিনি পালন করে গেছেন,তা তার উত্তরসূরিরা অনুসরণ করলে উপকৃত হবেন।অনুপ্রেরণা পাবেন।তিনি কমিশনের ক্ষমতা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি যে কিছু করেননি এমন নয়।তাই বলে তিনি জ্যোতি বসুর কথায় ‘পাগল’ ‘মাথা খারাপ’ ছিলেন না। একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার লােভ সামলানাে গেল না।
তাঁর সময়ে একটি নির্বাচনে রাজ্য প্রশাসনের অফিসারদের সঙ্গে একটি বৈঠক ছিল তখনকার গ্রেট ইস্টার্ন হােটেলে।একজন শীর্ষ অফিসার দু-এক মিনিট নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বে এসেছিলেন। মিটিং কক্ষে প্রবেশকালে তাকে দেখতে পেয়েই শেসন তাকে থামিয়ে দিয়ে,বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। এইরকম ঘটনার আরও নজির আছে,কিন্তু তার কর্তব্যপরায়ণতা ছিল তুলনাবিহীন।নির্বাচনী সংস্কার যা তিনি করতে চেয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেননি।কিন্তু যেটুকু পেরেছেন তার ওপর ভর করেই কমিশন এখন চলছে।