এই পাহাড়ে মা দূর্গার স্থায়ী বাসিন্দা

বাঙালী আর দূর্গা পূজো৷ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে যে একটি নাম নিলেই অপরটি আপনা থেকেই মুখে চলে আসে৷ গোটা বঙ্গ বছর ভর অপেক্ষা করে কবে মা দূর্গা কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসবেন৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয় ভারত সহ বাংলাদেশ বা বাঙালী যেখানে থাকে সেখানে বইবে আনন্দের জোয়ার৷ এই দূর্গার আবার নানা নামে নানা স্থানে পূজিতা৷ এই যেমন যেমন মেঘালয়ে৷ এখানেও আছেন দেবী দূর্গা৷ মেঘালয়ের পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড় জেলায় রয়েছে একটি পুরোনো মন্দির৷ নাম নার্তিয়াং দুর্গা মন্দির৷ মন্দিরের বয়স ৬০০ বছরেরও বেশি৷ ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম এই মন্দিরটি হিন্দু শাক্ত ভক্তদের কাছে অন্যতম পবিত্র স্থান৷ তবে মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাডে়র হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, এই মন্দিরটিই দেবী দুর্গার স্থায়ী বাসস্থল৷ দুর্গাপূজা উপলক্ষে সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে এসে ভিড় জমান৷ নার্তিয়াং দেবী মন্দিরের আরাধ্যা দেবী শক্তি জয়ন্তী এবং ভৈরব কামাদিশ্বর৷
এখানে দূর্গার বসবসাসের পেছনে আবার রয়েছে একটি রোমাঞ্চর কাহিনীও৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে, রাজা দক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহাদেবকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর কন্যা সতী৷ মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন৷ যজ্ঞে সতী কিংবা মহাদেব কাউকেই আমন্ত্রণ জানাননি দক্ষ৷ মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী বাবার আয়োজিত যজ্ঞানুষ্ঠানে যান৷ সেখানে দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন৷ স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন৷ শোকাহত মহাদেব দক্ষর যজ্ঞ পণ্ড করেন এবং দেবী সতীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন৷ তাঁর তাণ্ডব বন্ধ করতে অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন৷ এতে সতীর দেহের ৫১ খণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পডে় এবং পবিত্র পীঠস্থান শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নামে পরিচিতি৷ নার্তিয়াং সেই শক্তিপীঠের অন্যতম৷

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী জয়ন্তিয়া পাহাডে়র নর্তিয়াং-এ দেবীর বাম উরু পডে়ছিল৷ তাই এখানে দেবী জয়ন্তেশ্বরী নামে পরিচিত৷ জয়ন্তিয়া রাজা জাসো মানিক (রাজত্বকাল ১৬০৬-১৬৪১) কোচবিহারের হিন্দু রাজা নর নারায়ণের কন্যাকে বিয়ে করেন৷ এবং এর পরেই রাজ্যে হিন্দুধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করে৷ প্রায় ৬০০ বছর আগে রাজা ধন মানিক জয়ন্তিয়া রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে নর্তিয়াংকে ঘোষণা করেছিলেন৷ এক রাতে, দেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাঁকে স্থানটির তাৎপর্য জানান এবং তার সম্মানে একটি মন্দির তৈরি করতে বলেন৷ এরই ধারাবাহিকতায় নর্তিয়াং-এ জয়ন্তেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়৷ কৌশলগত অবস্থান এবং মন্দিরের ভিতরে কামানের মতো অস্ত্রের উপস্থিতি থেকে অনুমান করা হয় যে অতীতে মন্দিরটি জয়ন্তিয়া রাজাদের দুর্গের অংশ ছিল৷

এখানে হিন্দু এবং প্রাচীন খাসি ঐতিহ্যের মিশ্রণে দেবীর পুজো হয়৷ স্থানীয় সর্দার বা সাইয়েমকে মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ আজও দুর্গাপূজার সময় সাইয়েম ছাগল বলি দেন৷ দুর্গাপূজা এই মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব৷ দুর্গাপূজার সময়, একটি কলা গাছকে দেবী হিসেবে পূজা করা হয়৷ চার দিনের উৎসবের শেষে, গাছটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিন্টডু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়৷ বিদায়কালে শূন্যে হন্দুকের গুলি ছুডে় দেবীকে সম্মান জানানো হয়৷


বর্তমানে মেঘালয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের সরকারি প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় পূজা কমিটি মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক৷ মন্দিরের অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির দায়িত্বে রয়েছে এই কমিটি৷ প্রাচীন এই মন্দিরে দুর্গা পূজার অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ বাংলার সংস্কৃতি এবং খাসি-জয়ন্তিয়া পাহাডে়র সংমিশ্রণে শারদীয়া দুর্গাপূজা করা হয়৷ দেবী মূর্তির পরিবর্তে খাসি প্রথা মেনে গাঁদা ফুল দিয়ে সজ্জিত একটি কলার কাণ্ডে মা দুর্গার চিত্র তৈরি হয়৷ সেটিই আরাধ্যা দেবী৷ মন্দিরের কাছাকাছি একটি শিব মন্দির রয়েছে৷ সেখানে রয়েছে একটি প্রাচীন কামানের অবশেষ৷

যাতায়াত
বিমানপথে- মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে উমরোই বিমানবন্দর৷ কলকাতা এবং গুয়াহাটি থেকে সরাসরি বিমান পরিষেবা পাওয়া যায়৷ নারতিয়াং দুর্গা মন্দির থেকে উমরোই বিমানবন্দরের দূরত্ব প্রায় ৬৭ কিলোমিটার৷

সড়কপথে- নারতিয়াং থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার, শিলং বাসস্ট্যান্ড থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৬১ কিলোমিটার৷
রেলপথে- মন্দির থেকে গুয়াহাটি রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব প্রায় ১৫৩ কিলোমিটার৷ গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৭৭ কিলোমিটার৷