প্রয়াত নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া

অমলাশঙ্কর (File Photo: IANS)

প্রয়াত নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর । উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’র শিল্পী উমা চিরবিদায় নিলেন। শঙ্কর ঘরানায় একটি যুগের অবসান ঘটল। শুক্রবার ভোরে ঘুমের মধ্যে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ শয়ানে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করতে যান পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। শুক্রবার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় লিখেছেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করের মৃত্যুতে আমি গভীর শোকপ্রকাশ করছি। নৃত্যের মাধ্যমে তিনি রাজ্য বা দেশের সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্কর নিবেদিত ‘কল্পনা’ আজও জনপ্রিয়তা হারায়নি।


২০১১ সালে রাজ্য সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান প্রদান করে। অমলাশঙ্করের মৃত্যুতে নৃত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি অমলাশঙ্করের পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।

সকালে অমলাশঙ্করের প্রয়াণের খবর জানিয়ে টুইট করেন তাঁর নাতনি শ্রীনন্দাশঙ্কর। তিনি লেখেন ১০১ বছর বয়সে ঠাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। গত মাসেও আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করেছি। খুব অস্থির বোধ করছি। কারণ মুম্বই কলকাতা উড়ান বন্ধ থাকায় ঠাম্মার কাছে যেতে পারছি না। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

মেয়ে, জামাই, পুত্রবধু, নাতি, নাতনি নিয়ে ভরা সংসার রেখেই বিদায় নিলেন অমলাশঙ্কর। শতায়ু জীবন যাপনের তাঁর এই প্রয়াণে শূন্যতার অন্ধকার জমাট বাঁধে না। বরং এক সফল জীবনের পূর্ণতার আলো ছড়িয়ে যায়।

সেই আলোতে দেখা যায় অমলাশঙ্করের জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা। যে ভালোবাসা একটু একটু করে তিনি সঞ্চিত করেছিলেন জীবনে। বার্ধক্যে পৌছেও জীবনের প্রতি তার ভালোবাসায় এতটুকু টাল খায়নি। তা না হলে, নব্বই বছর বয়সে তিনি অপর্ণা সেনকে বলতে পারতেন, একটা ছবি করো, আমি শেষবারের মতো নেচে নিই।

অমলাশঙ্করের জীবন নৃত্যের তালে তালেই এগিয়েছে। ১৯১৯ সালের ২৭ জুন অবিভক্ত বাংলাদেশের যশোরে জন্ম অমলাশঙ্করের। ১৯৩১ সালে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল একজিবিশনে গিয়ে প্রথম উদয়শঙ্করের গ্রপে যুক্ত হন কিশোরী অমলা। তার কাছে তালিম নেন। দেশে বিদেশে উদয়শঙ্করের ডান্স টুপে সফর করতেন।

তারপর নাচের ছন্দের সঙ্গে কখন যেন জীবনের ছন্দের যুগন্দি ঘটে যায় অমলার জীবনে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে উদশঙ্করের সঙ্গে ব্রিাহ হয় তার। তারপর উদয়শঙ্করের একের পর এক সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অমলাশঙ্কর। গত শতাব্দীর চারেরর দশকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী দম্পতিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্কর।

তাঁর পুত্র সুরকার আনন্দশঙ্কর, কন্যা মমতাশঙ্কর সকলেই এই শিল্প পরম্পরার উত্তরাধিকারী। ক্রিয়েটিভ ডান্সকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন উদয়শঙ্কর ঘরানা তা আজকের প্রজন্মের কাছেও এক বিস্ময়।

উদয়শঙ্করের পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র কল্পনায় উমার ভূমিকায় ছিলেন অমলাশঙ্কর। কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল সেই কল্পনা। সেই সময় কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেওয়া সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী ছিলেন অমলাশঙ্কর। ২০১২ সালে আবারও একবার কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন অমলাশঙ্কর।

শিল্প তাঁর রক্ত-মজ্জায় মিশেছিল। আর সেই শিল্পবোধ একের পর এক মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। তার হাতের মুদ্রা কখন যেন রূপবদল করেছিল তুলির টানে, এমনকী লেখনীর অক্ষরবৃত্তেও। নাচের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের অভিব্যক্তিতেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নাচ থেকে আঁকা, অভিনয় থেকে লেখা– সবেতেই অমলাশঙ্কর ছিলেন সাবলীল।

একজন শিল্পীর সঙ্গে ‘গ্রেস’ শব্দটা যে কীভাবে সারাজীবনের জন্য জড়িয়ে থাকে তা বোঝা যেত শিল্পী অমলাশঙ্করকে দেখলে। বাড়ির গৃহসজ্জা প্রায়ই বদল করে ফেলতেন। নিজের হাতে আঁকা ছবি তার ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে শোভা পেত।

শেষ জীবনে সুস্থ থাকাকালীনও তিনি অত্যন্ত পরিপাটি থাকতেন। আসলে অমলাশঙ্করের মধ্যে যে শিল্পসত্তা ছিল তারই আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল নানারূপে নানাভাবে। মৃত্যু এই শতায়ু শিল্পীর জীবনে আগুনের পরশমণি ছোঁয়াবে ঠিকই, কিন্তু সেই আলো নেভাতে পারবে না। সেই আলো রয়ে যাবে যুগ থেকে যুগান্তরে।