শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মতো বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর হাসপাতালের তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিল সিবিআই। পাশাপাশি আরজি করে স্বাধীনতা দিবসের রাতে ভাঙচুরের ঘটনার রিপোর্ট জমা দেয় রাজ্যও। এদিন সুপ্রিম কোর্টে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার দ্বিতীয় দিনের শুনানি ছিল। আরজি কর-এ খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় ‘টাইমলাইন’ বা ঘটনার সময়সারণি নিয়ে রাজ্যের উদ্দেশে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলে সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য জানায়, সব কিছুর ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছে। শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, সিবিআইকে ফের মুখবন্ধ খামে তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিতে হবে। রাজ্যকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে । প্রধান বিচারপতি এদিন আরও বলেন, “আইন নিজের পথে চলবে। আমরা বলে দিয়েছি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে বাধা দেওয়া যাবে না।” বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি না করারও আর্জি জানান প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।
আর জি করের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে রীতিমতো অসন্তুষ্ট সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা রাজ্য সরকারের তরফে হাজির আইনজীবীদের ভর্ৎসনা করে বলেন, গোটা ঘটনায় আপনার রাজ্য যে পদ্ধতিতে কাজ করেছে, আমার ৩০ বছরের আইন জীবনে কখনও এমনটা দেখিনি। সময় ধরে ধরে আদালত বলে, সকাল ৫টা ২০ মিনিটে একটি পুলিশ ডায়েরি হয়। হাসপাতাল পুলিশকে বিষয়টি জানায় ১০টা ১০ মিনিটে। তাতে বলা হয়েছে, এক মহিলাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড নিশ্চিত করে ওটা ধর্ষণের ঘটনা ছিল। এবং সর্বোপরি পোস্ট মর্টেমের পরে অপরাধস্থল ঘেরে পুলিশ। এতক্ষণ তাহলে কী হচ্ছিল? রাজ্যের দেওয়া টাইমলাইন নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে সুপ্রিম কোর্ট।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “সকাল সাড়ে ৯টায় দেহ উদ্ধার হয়। আর রাত সাড়ে ১১টায় এফআইআর দায়ের হয়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে এফআইআর! এটা মানা যাচ্ছে না।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “কেন ১৪ ঘণ্টা দেরিতে এফআইআর দায়ের হল ? কেন অধ্যক্ষ এফআইআর দায়ের করতে এলেন না ? তাঁকে কি কেউ বাধা দিচ্ছিল? কেন তাঁকে বদলি করে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হল? এই সবের কারণ জানতে চায় আদালত।”
এদিন সর্বোচ্চ আদালতে স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেওয়া সিবিআইয়ের আইনজীবী অভিযোগ তুলে বলেন, নির্যাতিতার দেহ শেষকৃত্যের পরে এফআইআর হয়েছে। এতেই বোঝা যায় গোটা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় । সিবিআইয়ের আরও বক্তব্য ছিল, ‘আমরা ঘটনার পাঁচদিন পর তদন্তভার হাতে পেয়েছি। এর মধ্যে সবকিছু বদলে ফেলা হয়েছে।’
পলিগ্রাফ পরীক্ষার জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে সেটি বিবেচনা করতে হবে শিয়ালদহ এসিজেএমকে। বৃহস্পতিবার আরজি কর মামলার শুনানিতে এমনই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আরজি কর-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তের পলিগ্রাফ পরীক্ষা নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা। ধৃতের পলিগ্রাফ পরীক্ষা করানোর আর্জি জানিয়ে মঙ্গলবার শিয়ালদহ আদালতের দ্বারস্থ হয় সিবিআই। সূত্রের খবর, নিরাপত্তার কারণে সেখানে হাজির করানো হয়নি তাঁকে। মিথ্যা যাচাইয়ের এই পরীক্ষা করাতে আদালতের ছাড়পত্র লাগে। ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের পলিগ্রাফ টেস্ট করানোর জন্য সিবিআই শিয়ালদহ আদালতে আবেদন করে।
চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করার পরেই রাজ্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। পাল্টা অভিযোগ করেন রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল। দু’পক্ষের বাগ্যুদ্ধ দেখে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, “এই বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবেন না। আমরা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।”প্রধান বিচারপতি এদিন বলেন, “আইন নিজের পথে চলবে। আমরা বলে দিয়েছি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে বাধা দেওয়া যাবে না।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “১৩ দিন ধরে এইমসের চিকিৎসকেরা কাজ করছেন না। তাঁদের বলব, দয়া করে কাজে ফিরুন। আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হবে না – আমরা তা নিশ্চিত করব।” চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, “ওষুধ আর বিচারব্যবস্থা ধর্মঘট করতে পারে না। আমরা কি কাজ বন্ধ করে সুপ্রিম কোর্টের বাইরে বসে যেতে পারি?”
এদিন চিকিৎসকদের টানা ৩৬ ঘন্টা ডিউটি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন চন্দ্রচূড়। আরজি কর মামলার শুনানি চলাকালীন তাঁর পর্যবেক্ষণ, ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর যৌন নির্যাতন তো দূর, সামান্য নিগ্রহও রোখার ক্ষমতা থাকে না। আজ, এমনটাই পর্যবেক্ষণ রাখলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “চিকিৎসকদের আশ্বাস দিন যে আমরাও তাঁদের জন্য উদ্বিগ্ন। ওরা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করেন…আমাদের সকলেরই পরিবারের সদস্যরা সরকারি হাসপাতালে গিয়েছেন। আমার পরিবারেও যখন কেউ অসুস্থ হয়েছেন, তখন আমিও হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েছি। আমরা সবাই এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। আমরা দেখেছি চিকিৎসকরা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করছেন।”
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, “যদি অর্ডারটি দেখেন, তবে দেখবেন এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। সরকারি হাসপাতালগুলিতে এমন কাঠামো থাকে যেখানে জুনিয়র চিকিৎসকরা বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সেটা কেবল যৌন হয়রানিই নয়। আর এটা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। আমরা অনেক ই-মেল পেয়েছি। জুনিয়র চিকিৎসকদের ৪৮ ঘণ্টা, ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।”
হাসপাতালের মতো জায়গায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে; সবাই কী করছিল? প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। কী করে হাসপাতাল ভাঙচুর করতে দুষ্কৃতীরা ঢুকল এই ঘটনাতেও বিস্ময় প্রকাশ করেন।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক, পড়ুয়াদের পরামর্শ শুনবে ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে একটি পোর্টাল খুলতে বলা হয়েছে। সেখানে পরামর্শ জানানো যাবে। গত মঙ্গলবারের শুনানিতে দেশ জুড়ে হাসপাতালগুলির নিরাপত্তা কাঠামো ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের নিরাপত্তায় টাস্ক ফোর্স গঠন করার প্রস্তাব দেয়।আরজি কর মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ৫ সেপ্টেম্বর হওয়ার সম্ভাবনা।