জাহাজের নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ সেঁটে দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে লেখা—যাঁরা যাঁরা ক্যাম্পিং করবেন, তাঁরা যেন জাহাজের তিনতলার লাউঞ্জ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন৷ ক্যাম্পিং হবে পোর্টাল পয়েন্টে৷ আমাদের চার বান্ধবীর একজন সাসকিয়া ছুটল লাউঞ্জের দিকে৷ জাহাজের অভিযাত্রী দলের মধ্যে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি৷ এর মধ্যে সবার মধ্যে অতিপরিচিত হয়ে গেছেন আমেরিকার লাইসা৷ তাঁর বয়স আমার চোখের অনুমানে সত্তরের ওপর হবে৷ খর্বকায় মানুষটার চুল ফৌজি অফিসারের মতো ছোট৷ লাইসা হাঁটেন না, যেন নাচেন৷ সর্বক্ষণ জাহাজে এমনভাবে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটেন, যেন সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে নাচছেন৷ ভদ্রমহিলা একাই ঘুরতে এসেছেন, তিনি সবখানে সবার সামনে থাকেন৷ সহযাত্রীদের বিপুল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সিক্ত৷ তিনিও ছুটে চলছেন লাউঞ্জের দিকে৷ তাঁর যাওয়া দেখে আমি কিছুটা আতঙ্কিত! এই নারী সারা রাত বরফের গর্তে থাকবে!
সাসকিয়া জিনিসপত্র বুঝে নিয়েছে৷ তাকে দেওয়া হয়েছে ম্যাট্রেস, স্লিপিং ব্যাগ আর বরফ খোঁড়ার জন্য লম্বা হাতলের বেলচা৷ ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের বিকেলেই রাতের খাবার শেষ করে পোর্টাল পয়েন্টে পৌঁছাতে হবে৷ ক্যাম্পিংয়ের জিনিসপত্র নিজেদেরই বহন করতে হবে৷ বরফের মধ্যে যে গর্তে সারা রাত শুয়ে থাকতে হবে, সেটা খোঁড়ার কাজটিও নিজেকেই করতে হবে৷ কোনো রকম খাদ্য সেখানে নেওয়া যাবে না৷ সাসকিয়াকে বললাম, ‘তুমি আগাও, আমরা আসছি একটু পরে, গর্ত করার কাজে তোমাকে সাহায্য করব৷’
এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখা ভালো, একটি অভিযাত্রী দলের অল্প কিছুসংখ্যক অভিযাত্রী ক্যাম্পিং করতে পারেন৷ তাই যাঁরা সবার আগে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ নিশ্চিত করেন, তাঁরাই সেই সুযোগ পান৷ জনা বিশেক সৌভাগ্যবান আগে পৌঁছে গেলেন৷ আমরা যেহেতু ক্যাম্পিং করব না, তাই আমরা গেলাম দ্বিতীয় দফায়৷ জোডিয়াক আমাদের নামিয়ে দিল একটি সুউচ্চ শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের পাদদেশে৷ গাইড নির্দেশ দিলেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই হবে, না উঠে ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ এ ছাড়া আমরা যেখান দিয়ে হাইকিং করে উঠব, রাতে জাহাজে ফেরার সময় ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরব৷ তাই পদব্রজে চলো সবাই৷ আবার সাবধান করল এই বলে, এখানে হাইকিং করা বেশ মুশকিল৷ প্রত্যেকে যেন দুটো হাইকিং পোল সঙ্গে নিই৷ ভাবলাম গতকাল যেহেতু হাইকিং করেছি আমার জন্য এ আর তেমন একটা মুশকিলের হবে না৷ যা ভেবেছি পরিস্থিতি তার বিপরীত৷ পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পথ বেশ দীর্ঘ৷
ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীরা ক্যাম্পিং সরঞ্জাম নিয়ে উঠল কীভাবে! তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মাঝপথে পা মচকে পড়ে গেলাম৷ অপরিচিত এক অভিযাত্রী টেনে তুললেন৷ এবার একটু সিরিয়াস হলাম৷ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসছে৷ আমরা অভিযাত্রী দল হাঁটছি৷ আসলে পাহাড় বাইছি৷ অ্যান্টার্কটিকা যদি হয় হিমবাহের মরুভূমি, তবে আমরা এই মরুভূমির বেদুইন৷ সব ক্লান্তি নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে গেল যখন চূড়ায় উঠলাম৷ পাহাড়ে বরফের পুরুত্ব অনেক বেশি৷ কী আশ্চর্য! এই পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশ সম্পূর্ণ সমতল৷ ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীরা গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত৷ তাঁদের হাতে বেলচা৷ প্রত্যেকের গর্ত আয়তাকার৷ মেথিয়াস যে গর্তটা খুঁড়ছে সেটা বেশ বড়, দুজন শোয়ার মতো৷
তুমি এত বড় গর্ত খুঁড়ছ কেন? ‘আরে আমার সঙ্গে তো আমার গার্লফ্রেন্ডও ঘুমাবে, আমরা দুজন৷’ কী সর্বনাশ! আমি এত দিন তাদের স্বামী-স্ত্রী ভেবেছি৷ আমাদের বাঙালিদের এই এক বাজে স্বভাব৷ নারী–পুরুষ একসঙ্গে দেখলেই স্বামী-স্ত্রী ভাবতে শুরু করি৷ দুনিয়ায় যে এর বাইরেও সম্পর্ক হয়, ঠাহর করতে পারি না৷ শিরদাঁড়া টানটান করে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিচ্ছি৷ সম্পূর্ণ আকাশ মাথা নুইয়ে আমায় দেখছে৷ আকাশের এত কাছে আমি আগে কখনো যাইনি৷ সূর্য ডুবছে৷ দিগন্তে আবির৷ চারদিকের সফেদ বরফের ওপর আগুনের প্রলেপ৷ এই প্রথম মনে হলো পুরো অ্যান্টার্কটিকা দেখছি৷ এখন আমার আকাশ দেখার সময় নয়৷ সাসকিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে৷ তাকে গর্ত খুঁড়তে সাহায্য করতে হবে৷ আমার দুই হাতে দুটি হাইকিং পোল৷ শরীরের সমস্ত ভর তাদের ওপর দিয়ে হাঁটছি আর সাসকিয়াকে খুঁজছি৷ তাকে পেতে বেশি সময় অবশ্য লাগেনি৷ আমি পৌঁছানোর আগেই তার কাছে পৌঁছে গেছে সাঈদা আর ক্যারোলিন৷ তাদের থামিয়ে নিজেই হাত লাগালাম৷ বেশ শক্তি খাটাতে হচ্ছে৷ সহজ কাজ নয়৷ নিচের দিকের বরফ বেশ শক্ত৷ আঘাত করতে হচ্ছে জোরে৷ এই গর্তের প্রস্থ খুব বেশি না করলেও চলে৷ কাজটি আমার জন্য একেবারেই নতুন৷ তবু এটাকে কর্তব্য ভাবছি৷ আনন্দ পাচ্ছি এই ভেবে যে সাসকিয়ার ‘ক্যাম্পিং কবর’–এ আমরা বাকি তিন বন্ধু কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব৷ ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা নেব৷
ক্যাম্পিং মানেই তাঁবু টাঙিয়ে রাত্রিযাপন, কিন্ত্ত অ্যান্টার্কটিকায় বাতাসের গতিবেগ বেশি, তাই তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করা যায় না৷ এখানে রীতিমতো কবরে শুয়ে থাকার মতো অভিজ্ঞতা হয়৷ সাসকিয়াকে তোশক যেটা দিয়েছে, সেটি গর্তে বিছিয়ে দিলাম৷ তোশকের রং নিকষ কালো৷ সরবরাহকৃত স্লিপিং ব্যাগ টকটকে লাল৷ সিঁদুরের মতো৷ ব্যাগগুলো উষ্ণ আর মনোমুগ্ধকর৷ এবার সাসকিয়া স্লিপিং ব্যাগে তার পুরো শরীর ঢুকিয়ে দেবে, শ্বাস নেওয়ার জন্য নাকটা শুধু বাইরে থাকবে৷ কিন্ত্ত সাসকিয়া সেটা না করে আমাদের বলল, ‘এখন তোমরা শুয়ে থাকতে পারো যতক্ষণ খুশি, আমার জন্য তো সারা রাত রইল৷’ ধপাস করে শুয়ে পড়লাম আমি আর সাঈদা৷
সূর্য বিদায় নিয়েছে৷ আকাশে কোনো আবিরের চিহ্ন নেই৷ আকাশ এখন তারায় ভরা৷ চাঁদ স্পষ্ট নয়৷ এটি একরকম মরুভূমির অভিজ্ঞতা নেওয়ার মতো৷ গাইড বলছিলেন, যদি হিমবাহের কারণে বাতাসের গতি তীব্র হয় তবে ক্যাম্পিং বাতিল করতে হয়৷ তবে আজ আবহাওয়ার তেমন কোনো পূর্বাভাস নেই৷ আমাদের সময় শেষ৷ আমরা জাহাজে ফিরে যাব৷ রয়ে যাবে সাসকিয়ারা৷