‘নতুন ভারত’ নির্মাণের বাজেট

বাজেট পেশ করার পর নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। (Photo: Statesman News Service)

বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন মােদি সরকার, অথচ দ্বিতীয় মােদি সরকারের প্রথম বাজেটে না আছে আর্থিক সংস্কারের সাহসী পদক্ষেপ, না আছে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার লক্ষ্যে কোনও সদর্থক প্রয়াস।

ভারতের অর্থনীতির গতি এখন অনেকটাই শ্লথ, অপর দিকে রাজস্ব ঘাটতি কমানাের জন্য প্রয়ােজন বিশেষ উদ্যোগের কিন্তু এই দুই লক্ষ্যেই কোনও সদর্থক দিশা দেখাতে পারলেন না নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।

সীতারামনের কাছে আশা ছিল সঞ্চয়ে সুদের হারে ক্রমাগত পতন, মূল্যবৃদ্ধির ভারে ঝুঁকে পড়া মধ্যবিত্তের কাঁধেই। পরিস্থিতিতে তিনি কিছু আশার বাণী শােনাবেন মানুষকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঘটল বিপরীতটাই।


পেট্রোল-ডিজেলের অন্তঃশুল্ক ও সেস মিলিয়ে লিটার প্রতি দাম বাড়ল ২ টাকা, যার ফলে আগামী দিনে আরও মূল্যবৃদ্ধির খাড়া ঝুলে রইল মানুষের মাথার উপর।

এদিন সবচেয়ে লম্বা ভাষণ দিয়েছেন প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী। দীর্ঘ ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট। কিন্তু সংসদের ইতিহাসে বাজেটের দীর্ঘতম ভাষণে কিন্তু একবারও তিনি উল্লেখ করলেন না জ্বালানির দাম বাড়ায় মূল্যবৃদ্ধির গতি আরও দ্রুততর হলে তখন মানুষ কী করবেন।

আথচ এরকম হওয়ার কথা নয় কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশােধিত তেলের দাম পড়তির দিকে অথচ এটাকেই সুযােগ মনে করে অনায়াসে বাড়িয়ে দেওয়া হল পেট্রোল ডিজেলের দাম, যার ফলে শিল্প, কলকারখানা থেকে বিদ্যুৎ, পরিবহণ, রেল-বিমান, নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সহ খাদ্যপণ্য- সমস্ত কিছুর উপর এর প্রভাব পড়বে।

তা ছাড়া মধ্যবিত্তের ও নিম্নমধ্যবিত্তের আয়কর নিয়েও কোনও ঘােষণা নেই বাজেটে। শুধু নতুন বলতে প্যানের বদলে আধার নম্বর দিয়েও অতঃপর দাখিল করা যাবে আয়কর রিটার্ন।

তবে মধ্যবিত্তের জন্য যে একেবারে কিছুই নেই তা নয়। সীতারামন গৃহঋণের ক্ষেত্রে কিছু স্বস্তি দিয়েছেন তাদের। গৃহঋণের ক্ষেত্রে প্রদেয় সুদে অতিরিক্ত দেড় লক্ষ টাকা আয়কর ছাড়ের প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪৫ লক্ষ টাকার মধ্যে ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনলে সেই ঋণের উপর দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় মিলবে। আগে ২ লক্ষ টাকার উপর এই ছাড় মিলত। তবে এতে লাভ হবে খুব কম মানুষেরই।

এই অর্থবর্ষে দেশের ৩ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিকে কয়েক বছরে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করতে সীতারামন জানিয়েছেন পরিকাঠামাে ক্ষেত্রে এবং কর্মসংস্থানের সুযােগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বিনিয়ােগের পথ সৃষ্টি করবে, কিন্তু সেই পথটা কী তার কোনও হদিশ দিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।

তেমনই কৃষিক্ষেত্র নিয়ে নির্মলা ডাক দিয়েছে ‘গাঁও, গরিব, কিষাণ’-এর। বাজেটে বলা হয়েছে কৃষিশিল্প গড়ে তােলার কথা, কৃষিপণ্য পরিবহণেরও উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তার নির্দিষ্ট কোনও দিশা নেই।

নির্মলা শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, সরকারি নয়, বেসরকারি বিনিয়ােগ বাড়িয়ে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা দুর করা হবে। ব্যক্তিগত আয়করে অন্তবর্তী বাজেটে ৫ লক্ষ টাকা বার্ষিক আয়ের সিলিং ঘােষণা করলেও বছরে মূল ২.৫ লক্ষ টাকার আয়ে। আয়কর ছাড়ের সীমা একই রয়ে গেল।

তবে ৪০০ কোটি টাকার বার্ষিক লেনদেনের ব্যবসায় এবার ২৫ শতাংশ আয়করের কথা বলা হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়ােগ বা এফডিআই বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন সিঙ্গল ব্র্যান্ড, খুচরাে ব্যবসা, বিমান, বিমা, সংবাদমাধ্যম- এ সবে অবাধ রাস্তা খুলে দিল সরকার।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে গ্রামাঞ্চলে কত বাড়ি তৈরি হয়েছে, কত শৌচালয় তৈরি হয়েছে, কত সংখ্যক বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, এসব নিয়ে বিষদ খতিয়ান তুলে ধরে আগামী পাঁচ বছরের লক্ষ্যমাত্রার কথাও জানান।

কিন্তু তাঁর ভাষণে এসব নিয়ে কোনও প্রকল্প বা পরিকল্পনার কথার উল্লেখ করেননি সীতারামন। সীতারামন আরও জানান, আগামী পাঁচ বছরে ১.২৫ লক্ষ কিলােমটার রাস্তা তৈরি করবে সরকার। এর জন্য সরকার খরচ করবে ৮০ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে ৭০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত মূলধন জোগাবে সরকার। স্টিলের উপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হল, অপরদিকে সােনা আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক বাড়িয়ে করা হল ১২.৫ শতাংশ।

রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩.৩ শতাংশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাজেটে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা এই অর্থ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকাকে মর্যাদা দিয়ে বিবেকানন্দ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন নির্মলা। ‘নারী তু নারায়ণী’ স্লোগান তুলে অর্থমন্ত্রী ঘােষণা করেন স্বনির্ভর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক মহিলা জনধন অ্যাকাউন্টে ৫০০০ টাকা ওভারড্রাফট নিতে পারবেন। এছাড়া ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন মহিলারা।

পরিবেশবন্ধু ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহ দিতে এদিন অর্থমন্ত্রী ঘােষণা করেন এই প্রযুক্তির গাড়ি কিনলে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া হবে।এছাড়া সৌরবিদ্যুৎ ও সৌর আলাে ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে। সৌরশক্তি চালিত পণ্যের উপর বিশেষ ছাড়ের ঘােষণা রয়েছে বাজেটে।

সরকার এবার ২০ টাকার কয়েন বাজারে ছাড়তে চলেছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। কর্পোরেট ক্ষেত্রেও বিশেষ কিছু সুবিধার কথা ঘােষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

সীতারামনের এই বাজেট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা কিন্তু হতাশা প্রকট করেছেন। এত বড় জনসমর্থন নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন মােদি। তাঁর সামনে সুযােগ ছিল, কিন্তু সেই সুযােগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ সরকার। বাজেটে আর্থিক সংস্কারের কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। নেই পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতি হয়ে ওঠার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা।