রুণা চৌধুরী (রায়)
প্রতি বছরের মতো এবরেও গরমের চুটিতে ছোট বোনের ফ্যামিলির সঙ্গে হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম সিমলা কুলু মানালির উদ্দেশে৷ দলে ছিলাম আামরা মোট আটজন৷ ওদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরিবারই এই দলের প্রধান উদ্যোক্তা৷ বিকেল সাড়ে চারটেয় শিয়ালদা স্টেশন থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দেড়দিনের জার্নির পর সকাল সাড়ে দশটায় নিউদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে নেমে নিকটবর্তী পাহাড়গঞ্জ এলাকায় একটি হোটেল হাইলাইফে উঠলাম৷ সন্ধেবেলায় ট্যাক্সি ভাড়া করে অক্ষরধাম মন্দির, রাজঘাট দর্শন করলাম৷ মন্দিরের স্থিতি-স্থাপত্য, নিখুঁত কারকার্যে ভরা মার্বেলে মোড়া মন্দির, তার প্রশস্ত ঝকঝকে প্রাঙ্গণ, সিঁড়ি দেবদেবীর মূর্তি, সব মিলিয়ে এক ভক্তির পুণ্যতায় মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে৷ হোটেলে ফেরার তাড়া ছিল, কারণ সে রাতেই সিমলার জন্য বেরোতে হবে, তাই ডিনার পর্ব সেরে ফেরার লাগেজ গুছিয়ে রাত দুটোয় সিমলার উদ্দেশ্যে আরামদায়ক টাবেরা গাড়িতে উঠে বসলাম৷ গাড়িতে নিদ্রাদেবী বারবার হানা দিলেও সোজা হয়ে বসে অন্ধকারে আাচ্ছন্ন দু’পাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অবগাহন করে আট ঘণ্টার জার্নিকে পিছনে ফেলে সকাল দশটায় সিমলার পাদপীঠ স্পর্শ করলাম৷ আসার পথে ভোরের আলোয় পাহাড়ের চূড়ায় বরফ ও মেঘ জড়ানো দৃশ্য মনকে কোন স্বর্গদ্বারে যেন পৌঁছে দেয়৷ পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার ফোয়ারা ধারা নেমে আসার অপূর্ব দৃশ্য ভোলার নয়৷ এক নজরেই মন ভরিয়ে দেয়৷
ছোটবেলা থেকে কাশ্মীর সিমলার সম্বন্ধে বহু কাহিনি শুনে আসছি৷ বিশেষত, হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক ছবির লোকেশন সিমলার বরফাচ্ছন্ন পাহাড়ে, অথবা কাশ্মীরের ডাল লেকে শুটিং হয়েছে, আজ তার চাক্ষুষ হতে পেরে খুশির অন্ত রইল না৷
গুলমার্ক হোটেলের দুটো লাক্সারি রুমে আমরা ভাগ হয়ে গেলাম৷ ক্লান্তিহীন জার্নির পর হোটেলের রুমে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের অর্ডার দিলাম যে যার পছন্দ মতো৷ তবে এখানকার খাবারের দাম ন্যায্য দামের তুলনায় অনেকটাই বেশি৷ এক প্লেট মাংস ভাত আড়াইশ টাকা, দুটো ডিমের তরকারি পঞ্চাশ টাকা, ধাবাতে এক কাপ চা দশ টাকা, হোটেলে সেটা ডবল৷
এখানে সূর্যাস্ত হতে হতে রাত আটটা, ন’টা বেজে যায়৷ রাত ন’টায় চা পান করেছি এমন সময়ও গেছে৷ সেদিন পায়ে হাঁটা পথে কালীবাড়ি, ম্যাল রোডে ঘুরে বেড়ালাম৷ ম্যালরোড ব্রান্ডেড শপিং সেন্টারগুলির জন্য বিখ্যাত৷ দূর থেকে বরফে আবৃত পাহাড়ের অনাবিল সৌন্দর্য প্রাকৃতিক শোভায় যেন চার চাঁদ লাগিয়ে দিয়েছে৷ সৌন্দর্য প্রেমী আমি চটপট নিজের ক্যামেরায় সেসব অবর্ণনীয় সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দি করে নিলাম৷ সামনে পাল্লা দিয়ে বোরে মেয়ে ওর ক্যামেরা ক্লিক করেই চলল৷ বরফিলী হাওয়ার মাঝে হালকা শপিং সকলে সেরে নিলাম৷
পরদিন আমাদের টাবেরা পাহাড়ের সর্পিল রাস্তা ভেদ করে বিভিন্ন স্পট দেখাবার উদ্দেশ্যে কুফরি (Kufri) রওনা হল৷ ঘোড়ায় চেপে পর্যটকদের সঙ্গে ভিড়ে মিশে আমরাও টেলিস্কোপ দিয়ে নানান স্পট দেখে তৃপ্ত হলাম৷ মাথার উপরে জমাট নীল আকাশের ফ্রেম, ঝরনার রুপোলি জলধারা, পাহাড়ের গায়ে স্তরেস্তরে ছোট-বড় কাঠের বাড়ি, রঙিন আচ্ছাদনে ঘেরা, বরফের উপর ঝকঝকে রোদের মাঝেই মেঘের প্রাদুর্ভাব, কেয়ারি করা ফুলের বাগান, নানা ফলের গাছ, সে এক নয়ন লুভানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করলাম৷
বোনের বান্ধবীর দুই ছেলেমেয়ে সমান তালে মজা উপভোগ করছিল৷ মাত্র চার বছরের মেয়ের ভয়ডর বলে কিছুই নেই৷ বরং উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সকলের আগে৷ ওখানে স্থানীয় পোশাক ভাড়া করে আমরা সবাই সেজে নিলাম রঙিন সাজে৷ চলল ছবি তোলার পালা৷ গামবুট, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস, দাদুর দস্তানার মতো বিশাল গরম কোট তো পরাই আছে৷ সেইরূপে আচ্ছাদিত হয়ে বরফ কেটে কেটে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছোবার প্রবণতাই আলাদা৷ পা পিছলে পড়লে হাত, পা ভাঙার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারে৷ সন্তর্পণে চতুর্দিকের বরফাচ্ছন্ন সিমলার রূপালি পরশে নিজেদের ধাতস্থ করে ফেললাম৷ অদূরেই মাতাজির মন্দির দর্শন করলাম৷ ফানওয়ার্ল্ডে দোলনা, গো-কাট প্রভৃতি নানান রাইডস চড়ে অন্দরমহলের রেস্তরাঁয় লাঞ্চ সারলাম৷ সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে অপেক্ষারত টাবেরোতে চড়ে হোটেলে ফিরলাম৷
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে কুলুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম৷ অসাধারণ রাস্তার সৌন্দর্য, তার সঙ্গে বিয়াস নদীর ব্যাটরেস, মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক যাওয়ার সময় প্রবাহিনী তিস্তার র্যাটরেস৷ ওঃ! সে দৃশ্য কি সহজে ভোলা যায়? ঠিক এখানেও বিয়াস তার মোহময়ী রূপ নিয়ে অরণ্য আর পর্বতের পটভূমিকে অাঁকড়ে স্বচ্ছ জলের অনবরত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বয়ে চলেছে৷ চারদিকে জলের প্রবল আলোড়নের সাথে জলের মধ্যে পড়ে থাকা অজস্র শিলাখণ্ডের মধ্যে ছোট্ট মেয়ের লাফ মেরে চলে যাওয়া, শিলাখণ্ডের উপরে বসে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, সময়ের হিসেব থাকে না৷ নদীর স্রোতের মতই সময় বয়ে চলে৷ স্রোতস্বিনীর পাশে বসেই লাঞ্চ করলাম৷ সেরকম ধাবার ব্যবস্থা নদীর গা জুড়ে আছে৷ জ্যোৎস্নার আলোয় ঝলমল করে উঠবে বিয়াসের জল যদিও সেটা দেখা থেকে বঞ্চিত রইলাম৷ লাঞ্চ সরেই ওখানকার বিখ্যাত শাল ফ্যাক্টরি দেখে কিছু শপিং করে নিই, কারণ পরদিনই আমাদের মানালি রওনা হতে হবে৷ কুলু থেকে মানালি যাওয়ার পথে যে রাস্তা অতিক্রম করতে হবে সে অনবত্য জার্নি ভাষায় অবর্ণনীয়৷ রাস্তার এক-একটা মোড় ঘুরতেই অপূর্ব দৃশ্য আমাদের ক্রমশঃ রোমাঞ্চিত করে তুলছিল৷ কাঁচা রোদের ঝলমলে আলোয় বিয়াসের জল আমাদের শিরশিরে ঠান্ডার আমেজে সুখদ অনুভূতিতে ভরিয়ে তুলেছিল৷ অপরদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরাটোপের মাঝে ঝরনার কুলকুল ধ্বনি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফের চাকের উপর রোদের ঝিকিমিকি, ইতস্তত ছড়ানো রং-বেরঙের ফুলের গাছ, সে মনোহর দৃশ্য আমাদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে৷ হঠাৎ গাড়ি প্রবেশ করল পাহাড় কাটা টানেলের মধেে৷ বাচ্চাদের আনন্দোচ্ছ্বাস আর হাততালির সঙ্গে আমরাও উল্লসিত হয়ে উঠি৷ সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা টানেল শেষ হতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম মানালির চূড়ায়৷ চারদিকে অনেক ড্যাম নজরে পড়ল৷ আর বিয়াসের অবিরাম যাত্রাও নজর কাড়ল৷ সন্ধে সাড়ে ছটায় মানালির মঙ্গলদ্বীপ হোটেলে উঠলাম৷ আকে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল৷ গাড়ির ড্রাইভার এবং তার সঙ্গী সহকর্মী আমাদের মিসগাইড না করলেও সবকিছুই এক্সপেনসিভ জিনিসের সম্মুখীন করেছে৷ আর আমরাও ওদের হাতের পুতুলের মতো নির্দেশ পালন করেছি৷ তবে গাড়ি চালিয়েছে দুর্ধর্ষ, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে ওদের এক্সপার্ট হাত আমাদের অনেক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে৷ মানালির হোটেলে ফ্রেশ হয়ে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে সামনের মার্কেটে ঘুরে বেড়ালাম৷ বিদেশি র্পটকদের ভিড় দেখবার মতো৷ বিশেষতঃ ইজরায়েল থেকে আগত টু্যরিস্টরা ওখানে চার-ছ’মাসের জন্য ডেরা জমায়৷ তারপর স্বদেশে ফিরে যায়৷ মানালিতে অনেক মন্দির লক্ষ্য করলাম৷ চতুর্দিক বরফাচ্ছন্ন, পায়ের নীচে বরফ, বরফ পাহাড়ের চূড়ায়, সেই বরফাবৃত পাহাড়ে নানান দেবদেবীর মন্দির দর্শন করলাম৷ পর্যটকরা বরফ ছুঁড়ে একে অন্যকে মেরে যে মজার খেলায় মেতেছে, আমরাও সে স্বাদ গ্রহণ করলাম৷ স্নো-স্নো এভরি হোয়ার স্নো৷ বরফের হাতছানিকে বিদায় জানিয়ে পরের দিন ভোর পাঁচটায় রোটাংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম৷ মানালির বিখ্যাত স্পট৷ আরও উঁচুতে যারক জন্য এর নাম শূন্য পয়েন্ট রাখা হয়েছে৷ শূন্য পয়েন্ট নামেই বিখ্যাত৷ শূন্য পয়েন্টে সর্বদাই স্নো-ফল হয়৷ হাড় কাঁপানো ঠান্ডার জন্য নয়, এর অনুভবেও গায়ে শিরশিরে কাঁটা দেয়৷ শ্বাসকষ্ট হতে পারে ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে৷ ওখানে বরফের চূড়ায় দাঁড়িয়েও আমি আর বোনের মেয়ে মাম্পু ক্রমান্বয়ে ফটো তুলেছি৷ আমার মেয়ে এবার আসতে পারেনি৷ নইলে ফটো তোলায় ওরও জুড়ি নেই৷ ওখানকার অধিবাসীদের ব্যবহার, কথাবার্তা খুবই সহজ সরল ধরনের, পর্যটকদের মনে ছাপ ফেলে দেয়৷ বরফের মতোই স্বচ্ছ, নির্মল৷ রোটাংয়ে গাইডের মুখে এক অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্ব কাহিনি শুনেও সে রহস্য সন্ধানে যেতে না পারায় প্রচণ্ড অনুতপ্ত রয়ে গেলাম৷ সম্প্রতি ভারতের প্রথম মমির খোঁজ পাওয়া গেছে৷ রোটাং থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে ১২,০০০ ফিট উঁচু পাহাড়ে এক মমিকে সযত্নে রাখা হয়েছে৷ ৫৪৭ বছর আগেকার মমির গায়ে এখনও হলুদ রংয়ের কাপড় শরীরে লেপ্টে রয়েছে৷ মমির দাঁত, হাতের নখ, মাথার চুলের কিয়দংশ এখনও বর্তমান, মমিনর নাক দিয়ে নাকি কখনও রক্ত পড়তেও দেখা যায়৷
I.T.B.P.-র জওয়ানরা মাটি খোঁড়ারসময় প্রথম আবিষ্কার করে এবং মমি যে কোনও তিব্বতি বৌদ্ধ লামার সেটা তারা প্রমাণ করে৷ জওয়ানরা মন্দির দ্বারে ভজন কীর্তনে রত থাকে এবং প্রদীপ, ধূপ জ্বালিয়ে জ্যান্ত মমির পুজো করা হয় দৈনন্দিন নিয়মমাফিক৷ যে কোনও সময়ে নাকি মমির আত্মা জাগ্রত হতে পারে এমনও অনুমান করা হচ্ছে৷ গাইডের মুখে এ কাহিনি শুনে এক অজানা রহস্যে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেও প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অদম্য ইচ্ছাকে মনের মণিকোঠায় বাক্সবন্দি করে ফিরে আসতে বাধ্য হই পূর্ব পরিকল্পিত টিকিট বুকড থাকার জন্য৷ কিন্ত্ত অনেক পর্যটক দুর্গম পাহাড়ী পথ দরে এগিয়ে যাচ্ছে মমির দর্শন অভিপ্রায়ে৷ পরের দিন দিল্লির জন্য রওনা হলাম গাড়িতেই৷ এয়ারপোর্টে পৌঁছে জার্মান থেকে আগত ভায়া দুবাই হয়ে আসা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট এয়ার ইন্ডিয়াতে আমাদের জায়গা হয়ে গেল৷ মাত্র এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নিতে পৌঁছে গেলাম কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে৷
সিমলার অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানারি বরফিলী বৃষ্টির হিমেল ঠান্ডা, আর বিয়াসের মনমাতানো জলনিনাদ আমাকে আবারও প্রলোভন জানায় তুষারাবৃত উপত্যকায় ছুটে বেড়ানোর জন্য৷