একদিকে কাঠের চিতায় শব পোড়ানো হচ্ছে। ঠিক অপরদিকে শ্মশানের চিতার ওপরেই পূজিত হচ্ছেন মা শ্মশানকালী। কালীপুজোর রাতে মায়ের পুজোর ধূপ ধুনোর গন্ধ, আর শব পোড়ানোর গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কেওড়াতলা শ্মশানে এইরকম আবহেই গত ১৪৯ বছর ধরে পুজো হয়ে আসছেন মা শ্মশান কালী। এখানে শ্মশান মায়ের রূপ থেকে শুরু করে পুজো সমস্তটাই ব্যতিক্রমী অন্যান্য কালীপুজোর চেয়ে। অন্যান্য জায়গায় আমরা কালী মূর্তির জিভ বেরিয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু শ্মশান কালীর জিভ বেরোনো থাকে না। এখানে মায়ের রূপ খুবই শান্ত এবং স্নিগ্ধ। এই শ্মশান কালীর মূর্তিও বংশ পরম্পরায় একই শিল্পী এবং তাঁর পরিবার করে আসছেন। শিল্পী অরুণ পাল এই শ্মশান কালীর মূর্তি বানানো শুরু করেছিলেন এবং বংশপরম্পরায় তাঁরই পরিবারের লোকজন, বর্তমানে তাঁর স্ত্রী শ্মশান মায়ের মূর্তি বানান। যেমন এখানে একই শিল্পী বংশ পরম্পরায় মায়ের মূর্তি বানিয়ে আসছেন, ঠিক তেমনই শ্মশান কালী মায়ের পুজোও করেন বংশপরম্পরায় একই পুরোহিত। এই শ্মশানেই রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। যেখানে বসে সাধকেরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এছাড়া এই শ্মশানেই বিরাজ করছেন মহাকাল শিব। এছাড়াও এই শ্মশান কালী পুজো হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে। এই পুজোতে সূরা এবং মাংসের ব্যবহার করা হয়। এই পুজোর প্রধান পুরোহিত অরুণ ঠাকুরের কাছ থেকে জেনে নেওয়া গেল কিভাবে শ্মশান মায়ের পুজো হয়। অরুন ঠাকুর জানালেন, ‘ শ্মশান কালীমায়ের পূজা হয় বিরাচার তন্ত্রমতে। এই শ্মশান কালীর পুজোর একটা নিজস্বতা রয়েছে। এখানে যেমন বিরাচার তন্ত্রমতে পুজো করা হয় তেমনই, এই পুজোয় বিশেষ কিছু ক্রিয়া করা হয়, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা নিষেধ। অরুণ ঠাকুরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন শ্মশান কালী মায়ের জিভ অন্যান্য কালী মূর্তির মত বাইরে বেরিয়ে নেই? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, পুরান মতে মা অসুরকুল নিধন করে, শ্মশানে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং সূরা ও মাংস পান করছিলেন। জীবকুল এসে তখন মায়ের আশীর্বাদ নিচ্ছিল। সেই সময় মায়ের যে রূপ ছিল, শান্ত, স্নিগ্ধ, এখানে দেবী শ্মশান কালী মাতা ও সেই রূপেই পূজিত হন। আর সেই সময় যেহেতু মা খাচ্ছিলেন, তাই তাঁর জিভ বাইরে বেরিয়ে থাকে না। তাছাড়াও মা এখানে দ্বিভূজা। মা এখানে মূলত কল্যাণময় রূপে পুজিত হন।’ জানা যায়, শ্মশান কালী মায়ের পুজো শেষ হলেই, পুজোর ঘট শ্মশানের ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। কথিত আছে, যখন শ্মশান মায়ের পুজো শুরু হয়, তখন কোনও না কোনও শব আসে কাঠের শ্মশানে পোড়ানোর জন্য। একদিকে শব পোড়ানো শুরু হয়, আর অন্যদিকে শুরু হয় মায়ের পুজো। এখানে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৫ টা ছাগবলি হয়। পুজো কমিটির তরফ থেকে দুটো ছাগ বলি দেওয়া হয়। আর বাদবাকি মানুষের মনস্কামনা পূরণ হলে তাঁরা শ্মশান মায়ের সামনে ছাগবলি দেন। কথিত আছে , শ্মশান মা জাগ্রত এবং সকলের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। এখানে যে ছাগ বলি হয়, সেই বলির মাংসই রান্না করে মাকে নিবেদন করা হয়। তাছাড়াও প্রায় ৬০০ কিলো চাল-ডালের ভোগ হয় এখানে। পুজো শেষে যা জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বলা হয়, এই পুজো হরিজনদের। চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ডোম। ডোম এবং তাঁদের পরিবার এই পুজোর সমস্ত আয়োজন করে থাকেন। শ্রী শ্রী সাহানগর কেওড়াতলা শ্মশান কালীমাতা পূজা কমিটির সেক্রেটারি উৎপল সাহা জানালেন, এটা হরিজনদের পুজো। আমরা তাঁদের সাহায্য করে থাকি। মায়ের অলৌকিক কৃপায় এখানে আমাদের পুজোর বাজেট নিয়ে কোনদিন চিন্তা করতে হয় না। কিভাবে যেন মায়ের পুজো এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ের এত বিপুল খরচের টাকা ঠিক উঠে আসে। আমরা যে বাজেট নিয়েই পুজো করতে নামি না কেন, মায়ের কৃপায় আমাদের বাজেট ঠিক পূর্ণ হয়ে যায়। লোকের কাছে শ্মশান কালী মায়ের নামে চাঁদার টাকা চাইতে হয় না। লোকে যেচে চাঁদা দিয়ে যায়। এটাই কেওড়াতলা শ্মশান কালীমাতার মাহাত্ম্য। এখানের দেবী খুবই জাগ্রত এবং মনস্কামনা পূর্ণ করেন।’ এই পুজোর সভাপতি দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মালা রায়। প্রতিবছর এই শ্মশান কালীমাতার পুজোতে মানুষের ঢল নামে। মানুষ তাঁদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, মনোবাসনা জানাতে মায়ের সামনে দাঁড়ান জোর হাত করে।