রিউমাটোলজি এবং ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি কী, সে বিষয়ে অনেকেই জানতে চান। রোগীর শরীরের রোগ প্রতিষেধক প্রক্রিয়াতে কোনও সমস্যা দেখা দিলে, তখন তা রিউমাটোলজি এবং ক্লিনিক্যাল ইমিউনলজির পরিধির মধ্যে পড়ে।
সহজভাবে বলতে গেলে আমরা যাকে বাত বলি, অর্থাৎ অস্থিসন্ধির ব্যথা বা গাঁটের ব্যথা, মাংসপেশীর ব্যথা, কোমরে ব্যথা- এই সমস্যাগুলো সবই একজন রিউমাটোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়। এগুলি ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজিরও অন্তর্গত।
ব্যথা ছাড়াও অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করার দায়িত্ব পড়ে রিউমাটোলজিস্টেদের উপর। কিছু রোগে ব্যথা থাকতেই পারে কিন্তু সেটাই মূল উপসর্গ নয়। যেমন দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এসএলই (Systemic lupus erythematosus)- এর কথা। এক্ষেত্রে ব্যথা একটা সাধারণ উপসর্গ মাত্র। এসএলই–তে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি নানা সমস্যায় অক্রান্ত হতে পারে। বেশিমাত্রায় আক্রান্ত হয় ত্বক, কিডনি এবং আমাদের কার্ডিয়ো ভাস্কুলার সিস্টেম। এরোগে রক্তাল্পতা হতে পারে অর্থাৎ প্লেটলেট কমে যেতে পারে।
যদি ইমিউন ডিসরেগুলেশনের মতো সমস্যা হয়, অর্থাৎ যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক মতো কাজ করে না, তখনও ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজির সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরাই এর সুরাহা করেন। তবে আজ আমাদের আলোচ্য হল অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস।
বর্তমান সময়ে খুব আলোচিত একটি রোগ অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস, যা রিউমাটোলজির অঙ্গ। যত রকমের বাত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কমন বাত এটি। বিলেতের একটি সাম্প্রতিক সার্ভেতে দেখা গিয়েছিল যে, একটি হাসপাতালের আউটডোরে যত রোগী আসছেন, তাদের এক তৃতীয়াংশই ব্যথা যন্ত্রণায় ভুগছেন। এর মধ্যে শতকরা ৪০ শতাংশই অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের রোগী।
অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস কিন্তু প্রদাহমূলক অসুখ নয়, বরং কার্টিলেজ এর ক্ষয়জনিত অসুখ। আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ফলে কিছু মাইক্রো ট্রমা তৈরি হয় যার দ্বারা শরীরের বড়ো জয়েন্টগুলি এবং ওজনবাহী জয়েন্টগুলি বেশি আক্রান্ত হয়। হাঁটু, কোমরের জয়েন্ট, অ্যাংকল বা হাতের আঙুলের জয়েন্টও এর ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
তবে জানবেন, সব হাঁটু ব্যথাই কিন্তু অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস নয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি , প্রায় ৫০ শতাংশ হাঁটুর ব্যথার কারণ অন্যকিছু। কিন্তু শুরু থেকেই এর চিকিৎসা না হলে, পরে ইনফ্ল্যামেটরি আর্থ্রাইটিস থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এটা অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসে রূপান্তরিত হবে।
প্রদাহমূলক আর্থ্রাইটিসের কিছু বিশেষ লক্ষণ আছে। যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ৩০/৬০ মিনিটের মতো অতি তীব্র ব্যথা থাকে। জড়তা থাকবে জয়েন্টগুলোতে। কিন্তু ব্যথা কমানোর ওষুধ খুব ভালো কাজ দেবে। সাধারণ বাতের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ যেমন ধরা পড়ে ইএসআর (ESR, Erythrocyte Sedimentation Rate) কিংবা সিআরপি (C-reactive Protein, CRP) টেস্ট করালে। অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে কিন্তু এই টেস্ট-এও লক্ষণ স্পষ্ট হবে না।
যে-অস্থিসন্ধিগুলি আমাদের শরীরের বেশি ভার বহন করে যেমন, হাঁটু ও কোমরের জয়েন্ট- সেখানে অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস বেশি হয়। হাতের কার্পল জয়েন্ট, বুড়ো আঙুলের জয়েন্টেও এই বাত হয়। শৈশবে বা মাঝবয়সে জয়েন্টে কোনও চোট আঘাত থাকলে বা পায়ে কোনও অপারেশন হলে, অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা প্রবল। আবার শরীরের যে-অংশে দীর্ঘদিন ধরে বেশি ভার দেওয়া হয়, সেখানেও এই রোগ বাসা বাঁধে। খারাপ পশ্চারে হাঁটা বা একদিকে ওজন বেশি রেখে হাঁটলেও অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস হতে পারে।
এই রোগের ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রি-ডিসপোজিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেখা যায় মা-বাবা কিংবা তাদের আগের প্রজন্মের কারও অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস ছিল, তাহলে বংশানুক্রমিকভাবে এরোগের সম্ভাবনা প্রবল। পঞ্চাশোর্ধ মহিলাদের মধ্য অসুখটি বেশি দেখা যায়। যাদের দৈহিক ওজন বেশি, তাদের ভারবাহী জয়েন্টে বেশি চাপ পড়ার কারণেও এই রোগটি হয়। যারা স্পোর্টস-এ যুক্ত থাকার কারণে চোট-আঘাত পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা বেশি। যত মাইক্রো ট্রমা হবে, ততই অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা বাড়বে বেশি বয়সে।
এই রোগটি যাতে না হয়, তার জন্য কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, সেটা অনেকে জানতে চান। একদম স্পেসিফিক কিছু নেই। ওজন কমানো, সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে ওঠা নামা করা। চোট লাগা এড়াতে হবে- যদিও সেটা খুব কঠিন। ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি–র ঘাটতি এই অসুখের প্রকোপ বাড়ায়। ৪০ পেরোলেই এই দুটি উপাদানের সাপ্লিমেন্টেশন জরুরি। আরও কম বয়স থেকেই ভিটামিন ডি–র রিপ্লেসমেন্ট ডোজ লাগে ।
তবে সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি নিলেও এই বাত খুব একটা কমবে না। নির্দিষ্ট কয়েকটি ওষুধ আছে যার দ্বারা ব্যথার প্রকোপ কিছুটা কমে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা কমান, মাটিতে বসা এড়ান, হাঁটু মুড়ে বসবেন না। খুব বাড়াবাড়ি অবস্থায় লাঠি নিয়ে হাঁটার কথা বলা হয় রোগীকে, এতে জয়েন্টের উপর ভার কমে। প্রদাহমূলক বাতের চিকিৎসা দ্রুত হলে, অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস বাড়বে না। ওষুধে কাজ না হলে, ক্ষতিগ্রস্ত জয়েন্টে আমরা ইঞ্জেকশন দিই। স্টেরয়েড এক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। অন্যান্য কিছু সাপ্লিমেন্টেশনও আছে, যেগুলি হয়তো কারও কারও ক্ষেত্রে সুফল দেবে। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে এগুলি নেওয়া যেতে পারে।