সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাটিতে পা রাখতে সমস্যা। মাটিতে পা ফেলতে পারছেন না। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অথবা হঠাৎ ঘাড়ে ব্যথা, যে ব্যথা নেমে আসছে হাত বেয়ে। পিঠে ব্যথা অথবা রাতে বাড়িতে শোয়ার পর কোমরে ব্যথা শুরু, এমনকি পাশ ফিরতেও সমস্যা। চিকিৎসকেরা বলছেন, এই ধরনের কষ্টের উৎপত্তিস্থল কিন্তু সায়াটিকা স্নায়ু। দেহের সবচেয়ে মোটা এবং দীর্ঘতম স্নায়ু হল সায়াটিকা। যার উৎসস্থল হল মেরুদণ্ড। সেখান থেকে কোমর হয়ে একেবারে পায়ের পাতা পর্যন্ত তা বিস্তৃত।
সায়াটিকা ব্যথা হয় নানা কারণে। এর অন্যতম কারণ স্লিপ ডিস্ক। চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু জানালেন, শিরদাঁড়ার দুটো হাড়ের মধ্যে ডিস্ক থাকে। ডিস্ক হল একটি চাকতি আকৃতির যা মেরুদন্ডের দুটি হাড়ের মধ্যে একটি সমতল কুশনের মতো থাকে, এবং একটি হাড়ের সঙ্গে অপর হাড়টিকে ঘষতে বাধা দেয়। যখন এই ডিস্ক তার সঠিক অবস্থান থেকে সরে যায় তখন তা পাশের কাঠামো বা স্নায়ুর উপর চাপ দেয়। যার ফলে তীব্র ব্যথা হয়, হাঁটাচলা করতেও সমস্যা হয়। অনেক সময় দেখা যায় অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রেও এই ব্যথা এমন তীব্র ব্যথা হয় যে রোগীকে স্ট্রেচারে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে। কোমরে ব্যথার মতো অনেক সময় ঘাড় থেকে ব্যথা হাতের দিকে আসছে এমনও হয়। এটাও স্লিপ ডিস্ক। চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু জানাচ্ছেন, শিরদাঁড়ার তিনটি ভাগ রয়েছে। ঘাড়, পিঠ, কোমরে ব্যথা এক্ষেত্রে কারণ হতে পারে।
চিকিৎসক জানাচ্ছেন, স্লিপ ডিস্ক মূলত অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। পিনের মতো ব্যথা হয় সফট টিস্যু গুলোর উপর চাপ পড়লে। কোমরে ব্যথা, পা ঝিনঝিন করা, পায়ে টান ধরার মতো সমস্যা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শুয়ে বা বসে থাকলে ব্যথা কমে যাচ্ছে, একটু হাঁটলে বেশি সমস্যা হচ্ছে। পায়ে জ্বলুনির মতো সমস্যা, পা ভারী ও অবশ হয়ে আসা, পায়ের পাতা তুলতে অসুবিধে হয় নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হলে। এই সব ক্ষেত্রেই রোগীকে দেখে স্থির করতে হয় কী চিকিৎসা প্রয়োজন।
চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু জানালেন, অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে বসা-শোয়ার ভুল ভঙ্গি, পড়ে যাওয়া কিংবা ভারী জিনিস তোলার সময়ে কোনও ভাবে সেই স্নায়ুতে আঘাত লাগলে এমন অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে। কারও আবার আলপিন ফোটার মতো অনুভূতি হয় সারাক্ষণ। কিন্তু ব্যথা কমানোর ওষুধ তো সারা জীবনের সঙ্গী হতে পারে না, তাহলে উপায় কী ? চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু জানাচ্ছেন, ব্যথার শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে, ওষুধ এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত ব্যায়াম করলে ব্যথা সেরে যায়। ফিজিওথেরাপিও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত কয়েকটি আসন অভ্যাস করলে এই কষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
দ্বিতীয় কারণ স্পাইনাল টেনোসিস, বা হাড়ের ক্ষয়। এই ক্ষয়ের ফলেও নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে হাড় হাড়ের উপর উঠে আসে। সেক্ষেত্রে দুটি হাড়ের মুভমেন্ট স্বাভাবিক হয় না। এসব ক্ষেত্রে এমআরআই বা সিটি স্ক্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বয়স ৫০ থেকে ৬০ হয়ে গেলে হাড়ের সমস্যা শুরু হয়ে যায়, হাড়ের ক্ষয় হতে শুরু করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে জন্মগত সমস্যাও থাকে। এমআরআই বা সিটি স্ক্যান করলে বোঝা সম্ভব হয় কী কারণে ব্যথা হচ্ছে। স্পাইন বা শিরদাঁড়া থেকে সমস্যা আসছে কিনা তা এমআরআই করে বোঝা হয়। এক্স-রে করেও বোঝা যায়। সিটি স্ক্যানও অনেক ক্ষেত্রে লাগে। অনেক ক্ষেত্রে জন্মের পর যদি সঠিকভাবে হাড় তৈরি না হয়. বা জন্মগত ত্রুটি থাকে সেক্ষেত্রে সিটি স্ক্যানের প্রয়োজনীয়তা বেশি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পাইনাল টেনোসিস, স্পন্ডেলোসিস হয়। নিয়মিত ব্যয়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, হাড় এবং স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে ববে। ওজন বাড়লে, সমস্যাগুলি আরও বাড়বে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে লাইফস্টাইল কারণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এই রোগ বংশগতও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা তীব্র হয়, এমনকি ইউরিন বা স্টুল ধরে রাখতেও অসুবিধে হতে পারে।
চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু জানান, ফিজিওথেরাপি এই ব্যথা উপশমের ক্ষেত্রে খুব গুরত্বপূর্ণ। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে তা করতে হবে। কোনও ভিডিও দেখে নিজে নিজে করা একদমই উচিত নয়। কারণ বিভিন্ন্ ধরণের ব্যথার জন্য বিভিন্ন ধরণের ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে কোনও রোগীর কী ধরণের ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন, এবং তা স্থির করে দেবেন একজন চিকিৎসকই। সেই থেরাপি কতদিন নিতে হবে, কখন নিতে হবে তা একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন । তীব্র ব্যথা হলে থেরাপি বা ব্যায়াম করা যায় না। ব্যথা কমলে থেরাপি বা ব্যয়াম.করতে হবে।
সায়াটিকার ব্যথা উপশমে মোট তিনটি ধাপ আছে। প্রথমেই চিকিৎসকেরা ওষুধ এবং ব্যায়াম দেন। তাতে যদি না তমে, তবে দ্বিতীয় ধাপ হল ইঞ্জেকশন। ইঞ্জেকশনে কাজ হলে খাওয়ার ওষুধের ডোজ কমিয়ে দেওয়া হয়। সার্জারিও এড়ানো যায়। তৃতীয় ধাপ হল অপারেশন। এখন অপারেশনও খুবই নিরাপদ হয়ে গেছে বলে জানালেন চিকিৎসক অনিন্দ্য বসু। মাইক্রো সার্জারি, শুধ দুটি মাত্র ছিদ্র করে করা সম্ভব। অপারশন করে নার্ভের উপর থেকে চাপ সরিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র একটি বা দুটি সেলাই পড়ে, কয়েকঘন্টার মধ্যে রোগীকে ছেড়েও ছেড়ে দেওয়া হয়। নিউরোসার্জন অনিন্দ্য বসু জানালেন অধিকাংশ রোগিকেই সার্জারি থেকে ভালো করে তোলা সম্ভব।
চিকিৎসকের পরামর্শ, প্রতিদিন ব্যয়াম করুন, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, কাজ করার সময় সঠিকভাবে বসতে হবে, চেয়ার যেন সঠিক থাকে, বিছানা যেন সঠিক হয়. এবং অবশ্যই সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে হবে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন -ডি খেতে হবে। তবেই এই ব্যথা থেকে মুক্তি মিলবে।