কিছু ব্যক্তির অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত ঘাম হয়। এতটাই যে তাদের জামাকাপড় ভিজে যায় ঘামে। এই অতিরিক্ত ঘাম, যা হাইপারহাইড্রোসিস নামে পরিচিত, তা অস্বস্তি এবং সামাজিক উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সল্টলেকের আইএলএস হাসপাতালের কনসাল্ট্যান্ট ফিজিশিয়ান (জেনারেল মেডিসিন) ডা. সর্বজিৎ রায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে, তিনি হাইপারহাইড্রোসিস অসুখটির কারণ, লক্ষণ এবং কার্যকর প্রতিকারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন।
হাইপারহাইড্রোসিস কী?
হাইপারহাইড্রোসিস হল এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য, প্রয়োজনীয় পরিমাণের বাইরে অতিরিক্ত ঘাম উৎপাদন করে। একজন ব্যক্তি তাপ বা শারীরিক পরিশ্রমের সংস্পর্শে না এলেও এটি ঘটতে পারে।
শীতের পরে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, গ্রীষ্মের প্রখরতা বাড়ার আগেই দেখা যায় অনেকে অত্যধিক ঘাম অনুভব করতে শুরু করেন। এর কারণে যা যা হতে পারে-
দৈনন্দিন কাজে অস্বস্তি
* ঘামের কারণে সারাক্ষণ জামাকাপড় ভিজে থাকতে পারে, যার ফলে অস্বস্তি কাজ করে।
শরীরে দুর্গন্ধের সমস্যা
* অতিরিক্ত ঘাম, ব্যাক্টেরিয়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে, যা অপ্রীতিকর গন্ধের কারণ হয়ে ওঠে।
সামাজিকভাবে বিব্রত হওয়ার অবস্থা
* হাইপারহাইড্রোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জনসমক্ষে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন।
হাইপারহাইড্রোসিসের কী কোনও প্রকারভেদ হয়?
হাইপারহাইড্রোসিস দুটি ধরনের হতে পারে। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস।
প্রাথমিক হাইপারহাইড্রোসিস- এটি কোনও সনাক্তযোগ্য চিকিৎসার কারণ ছাড়াই ঘটে। এটি সাধারণত স্থান বিশেষে হয় এবং শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশকেই প্রভাবিত করে। যেমন হাতের তালুতে ঘাম জমা। এটা হাত মেলানো বা জিনিস ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলতে পারে।
এছাড়া আন্ডারআর্মস ভিজে থাকলে-জামাকাপড়ও ভিজে যেতে পারে। যার ফলে অস্বস্তি হতে পারে। পা অতিরিক্ত ঘামলে জুতোয় গন্ধ হতে পারে। ঘামের কারণে তলপেট পিচ্ছিল হতে পারে। কুঁচকি অঞ্চলে ঘাম জমলে তা জ্বালা এবং অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এটি প্রায়শই বংশগত, যার অর্থ এটি পরিবারের অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হতে পারে। এটি সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে বা শৈশবে শুরু হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।
সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস- এটি অন্তর্নিহিত কোনও চিকিৎসা অবস্থার কারণে বা ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঘটে। এটি প্রায়শই জেনেরালাইজ করা হয়, যার অর্থ হল এটি কেবল নির্দিষ্ট এলাকার নয়- গোটা শরীরকেই প্রভাবিত করে। এই অসুখটির সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে-
* থাইরয়েড ব্যাধি- এর কারণ অতিরিক্ত সক্রিয় থাইরয়েড, (হাইপারথাইরয়েডিজম) যা ঘাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
* রক্তে শর্করার মাত্রা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)- রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ কমে গেলে অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
* কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- প্যারাসিটামল (জ্বরের জন্য ব্যবহৃত) এবং কয়েকটি অ্যান্টি-নডিপ্রসেন্টের মতো ওষুধ, ঘাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
* স্থূলতা- শরীরের অতিরিক্ত ওজন বা উচ্চ বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপের কারণে ঘাম হওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
* মেনোপজ- মেনোপজের পর্বের মধ্য দিয়ে যাওয়া মহিলারা প্রায়শই রাতে ঘাম হওয়া এবং হট ফ্লাশ অনুভব করেন।
* স্নায়ুর ক্ষতি- ডায়াবেটিস বা মেরুদণ্ডের আঘাতের মতো অবস্থায় ঘাম গ্রন্থির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এই অসুখের কী কী লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দেন আপনি, যা স্বাস্থ্যের অবস্থার ইঙ্গিত দিতে পারে?
হঠাৎ, কোনও অজানা কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি বা ধড়ফড়ানি-সহ ঘাম হওয়া (এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ কমার ইঙ্গিত দিতে পারে)। এছাড়া রাতে ঘামা (ঘুমানোর সময় প্রচুর ঘাম হওয়া, যা সংক্রমণ বা হরমোনের পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হতে পারে)। শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশের পরিবর্তে পুরো শরীরের উপর ঘাম (মধ্যম হাইপারহাইড্রোসিস )জমতে পারে। যদি এই লক্ষণগুলি ঘন ঘন দেখা দেয়, তবে মূল কারণ নির্ধারণের জন্য একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
হাইপারহাইড্রোসিসের কারণে কীভাবে সাধারণ জীবন ব্যহত হয়?
কোনও অন্তর্নিহিত অসুস্থতা ছাড়াই, হাইপারহাইড্রোসিস দৈনন্দিন কাজকর্মকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু মানুষের অসুবিধাজনক অভিজ্ঞতা হয় তালুতে ঘাম জমার কারণে। লেখা, টাইপ করা বা জিনিস ধরে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। আন্ডারআর্মসে ঘাম জমলে জামাকাপড় দৃষ্টিকটূ ভাবে ভিজে যেতে পারে, যা মানুষের ইমেজ নষ্ট করতে পারে। ঘামযুক্ত পা, ছত্রাকের সংক্রমণ এবং দুর্গন্ধের ঝুঁকি বাড়ায়। অত্যধিক ঘামের কারণে বডি ওডরও বিব্রত হওয়ার মতো একটি বিষয়।
হাইপারহাইড্রোসিস নিয়ন্ত্রণে জীবনযাত্রায় কি পরিবর্তন আনা দরকার ?
অতিরিক্ত ঘাম নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পরামর্শ দেব। প্রথমত হাইড্রেশন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ঘামের ফলে ডিহাইড্রেশন হয়, যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। শরীরে ঘাটতি থাকা খনিজগুলি পুনরায় পূরণ করতে প্রচুর পরিমাণে জল এবং ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ তরল পান করুন।
ঘামের মধ্যে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রয়োজনীয় লবণ এবং খনিজ থাকে। ঘামের কারণে তা অপসারিত হতে থাকে। তাই ডায়েটে পটাসিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম (যেমন কলা, বাদাম, নারকেলের জল) সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন।
এছাড়া স্নান, ঘাম এবং ব্যাকটেরিয়া অপসারণে সাহায্য করে এবং শরীরের গন্ধ প্রতিরোধ করে। তাই দিনে অন্তত দু’ বার স্নান করুন, বিশেষ করে গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ায়।
ট্যালকাম পাউডার বা অ্যান্টিপারস্পির্যান্ট ব্যবহার করুন। ট্যালকম পাউডার আর্দ্রতা শোষণ করে এবং ত্বককে শুষ্ক রাখে। হাতের নিচের দিক, হাতের তালু এবং পায়ের মতো সমস্যাযুক্ত জায়গায় হালকা, জ্বালা-পোড়া না করা পাউডার লাগান। এটির বিকল্পে অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড-যুক্ত অ্যান্টিপারস্পির্যান্ট ব্যবহার করুন, যা ঘাম গ্রন্থিগুলিকে অবরুদ্ধ করে।
আর অবশ্যই হাওয়া বাতাস খেলবে এমন পোশাক পরুন। কিছু ফ্যাব্রিক তাপ এবং আর্দ্রতা আটকে রাখে, যা ঘামলে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। হালকা সুতির পোষাক পরুন, যা আর্দ্রতা মুক্ত রাখতে সহায়তা করবে।
ক্যাফেইন ও মশলাদার খাবার কমাতে হবে কারণ ক্যাফেইন এবং মশলাদার খাবার ঘাম গ্রন্থিগুলিকে উদ্দীপিত করে। কফি, চা, গোল মরিচ এবং মদ্যপান সীমিত করুন।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করুন, কারণ এটা ঘামের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যোগব্যায়াম, ধ্যান বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করুন।