ফ্যাটি লিভারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা

ডা.প্রকাশ মল্লিক

মদ্যপায়ীদের লিভার খারাপ হয়, এটা তো নতুন কথা নয়, এটা সবাই জানে৷ কিন্ত্ত যারা জীবনে মদ ছোঁয়নি তাদেরও লিভারের অসুখ এখন প্রায় মহামারীর আকার নিয়েছে সারা পৃথিবীজুড়ে৷ ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ৷ এবার এই অসুখের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হল লিঙ্গবৈষম্য৷ বরাবরই দেখা গিয়েছে যে মেয়েদের লিভার খুব কমই হয়৷ একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মেয়েদের এই সুরক্ষার নেপথ্যে রয়েছে ইষ্ট্রোজেন হরমোনের ধর্ম৷

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন যে, সারা পৃথিবীতে যেখানে ওবেসিটি চরম আকার নিয়েছে, সেই সন্ধিক্ষণে ফ্যাটি লিভার ও লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধের ভালো ওষুধ তৈরির দিশা দেখিয়ে দিল এই গবেষণা৷ লিভার ক্যান্সারের অন্যতম বড় কারণ হল নন্ অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার৷ চিকিৎসকরা আরও বলেছেন যে, মোনোপেজ বা রজঃ নিবৃত্তি পর্যন্ত মহিলাদের ফ্যাটি লিভার প্রায় হয়ই না৷ এর কারণ হল, ততদিন মহিলাদের শরীরে ইষ্ট্রোজেনের কোনও অভাব থাকে না৷


অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, ফ্যাটি লিভারের শিকার হওয়ার নিরিখে মোনোপেজের পরে মহিলাদের সঙ্গে পুরুষদের আর বিশেষ ফারাক থাকে না৷ এই গবেষণাটি মূলত ইঁদুরের উপর করা হয়৷ এদের হাই-ফ্যাট ডায়েট খাইয়ে ইঁদুরগুলিকে মোটা করে তুলেছিলেন৷ তারপর দেখেছিলেন কতগুলি ইঁদুর ফ্যাটি লিভারের শিকার৷ দেখা গেছে অধিকাংশই পুরুষ ইঁদুর৷ বাইরে থেকে তখন তাদের ইষ্ট্রোজেন ইনজেকশন দেওয়া হয়৷ তাতে দেখা যায়, ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে৷ ধীরে ধীরে সেরে উঠছে ফ্যাটি লিভার৷ গবেষণায় দেখা গেছে যে এক্ষেত্রে টি-ই-এডি-১ নামে একটি প্রোটিনই লিভারে ফ্যাট জমতে বাধা দেয়৷ কিন্ত্ত যারা মোটা হল তাদের শরীরে প্রোটিনের অভাব দেখা যায়৷ আর ইষ্ট্রোজেন সেই প্রোটিনকেই চাঙ্গা করে তোলে৷ এতেই চিকিৎসকদের সামনে ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার ওষুধ তৈরির রাস্তাটি খুলে যায়৷ পরবর্তী ধাপে মানুষের শরীরে এই গবেষণাটি আরও বিশদে করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷ এর প্রতিকারের দিশাটিও এখন স্পষ্ট৷ এর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আছে, যার দ্বারা রোগীকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার দ্বারা সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব৷

ফ্যাটি লিভার কী
লিভারের উপর ফাট বা মেদের আস্তরণ পড়ে যায় ফ্যাটি লিভারে৷ এর ফলে লিভারের কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ অত্যন্ত ধীরে এই রোগটি ছড়াতে থাকে৷ সেজন্য রোগী অসুখটার অস্তিত্ব বুঝতে দেরি করে ফেলে৷

কীভাবে হয় ফ্যাটি লিভার
অতিরিক্ত মদ্যপান, স্থূলত্ব বা ওবেসিটি এবং ডায়াবেটিস হল সবচেয়ে বড় কারণ৷ অন্যদের তুলনায় এদের শরীরে যে অতিরিক্ত ফ্যাট জমে, তার একাংশ লিভারেও জমতে শুরু করে৷ কিছু বিপাকজনিত রোগের জেরেও এই অসুখ হয়৷ তবে সমস্যা হল জীবন শৈলির ধরনে৷ ফ্যাটি লিভার দুই ধরনের হয়— অ্যালকোহলিক এবং নন-অ্যালকোহলিক৷ অর্থাৎ মদ্যপানের কারণে ও অন্যান্য কারণে৷

কাদের এই রোগ বেশি হয়?
এই রোগ যে কারও হতে পারে৷ মদ্যপায়ীদের ৯০ শতাংশ এই রোগের শিকার৷ তবে মদ খান না এমন মানুষও আজকাল ত্রুটিপূর্ণ জীবন শৈলীর কারণে এই রোগের শিকার হন৷ ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের সমস্যা থাকলেও এই রোগ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়৷

ফ্যাটি লিভারে ভয় কোথায়?
এমনিতে কিছু বোঝা যায় না৷ কিন্ত্ত ফ্যাটি লিভার (বিশেষত নন-অ্যালকোহলিক) প্রায়ই লিভার ক্যান্সারে পরিণত হয়৷ এই অসুখের জেরে লিভার শক্ত হয়ে গেলে মদ্যপায়ীদের মধ্যে সিরোসিসও দেখা যায়৷

ফ্যাটি লিভারের উপসর্গগুলি কেমন
ফ্যাটি লিভার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন, কখনও কখনও বিনা কারণে অসম্ভব ক্লান্তি লাগে৷ কখনও বা ডানদিকের উপরের পেটে ব্যথা বা যন্ত্রণা হয়৷ আবার কমেও যায়৷

ফ্যাটি লিভার সন্দেহ কখন, কী করণীয়
যদি রোগী মদ্যপায়ী হন বা ভুঁড়ি থাকে বা ওবেসিটি / ডায়াবেটিস / উচ্চরক্তচাপ কোলেস্টরেলের শিকার হন বা উৎশৃঙ্খল জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস থাকে, তাহলে বছরে অন্তত একবার লিভার ফাংশন টেস্ট করতে হবে৷ এস জিপিটি এবং এসজিওটি-লিভার থেকে বেরোলে এই দুটি উৎসেচকের মাত্রা বোঝা যায় রক্ত পরীক্ষায়৷ উৎসেচক দু’টির স্বাভাবিক মাত্রার উর্ধ্বসীমা যথাক্রমে ৬০ ও ৪৫ ইউনিট / লিটার৷ টেস্টে বিলরুবিন স্বাভাবিক থাকা (১-এর কম) সত্ত্বেও যদি দেখা যায় উৎসেচকের মাত্রা বেশি তার মানে, তা ফ্যাটি লিভারের কারণে হচ্ছে৷ যদিও এ দু’টির মাত্রা ১০০-র নীচে থাকলে তেমন চিন্তার নেই৷ ফ্যাটি লিভারের মাত্রা আরও বেশি হয়৷

ফ্যাটি লিভার ধরার কোনও পরীক্ষা আছে
লিভার ফাংশন টেস্টে গণ্ডগোল ধরা পড়লে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করা দরকার৷ তাতে অনেকটা বোঝা যায়৷ তবে সবচেয়ে এমআরআই-এর মাধ্যমে এতে লিভারের কোন অংশে কতটা ফ্যাট জমেছে, তা বোঝা ও সেই মতো চিকিৎসা হয়৷

চিকিৎসা কী
এর ভালো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আছে সেই সঙ্গে জীবনশৈলীর পরিবর্তন, ব্যায়াম, রোজ ২০ মিনিট হাঁটা, সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, ভূঁড়ি, ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার৷ এছাড়া ওষুধ তো আছেই৷

সতর্কতা:
মদ্যপান চলবে না, ভাজাভুজি, তেলমশলা যুক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ, মিষ্টি, ময়দা, চিজ, রেড নিট এড়িয়ে চলতে হবে৷ খেতে হবে শাকসবজি, ছোট মাছ, চিকেন স্টু, স্যালাড, ফল, টক দই৷