কাজল কালো দীঘল চোখ, টান টান ত্বক, উজ্জ্বল গায়ের রং- সবই ম্লান হয়ে যায় যদি না থাকে রেশমের মতো মাথাভরা এক ঢাল চুল। কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে চুলের যত্ন নেওয়ার সময় কোথায়? যত্ন আর সময়ের অভাবে চুলের সৌন্দর্যও আর তেমনভাবে চোখে পড়ে না। তার উপর মহিলা-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এখন প্রধান সমস্যা চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, বা টাক পড়ে যাওয়া। জীবনযাত্রার কারণেই হোক কিংবা বয়স, চুল কমতে শুরু করলেই তার প্রভাব পড়ে মনের উপরেও কারণ নিজেকে সবসময় ঝকঝকে দেখতে, তরুণ দেখতে কার না ভালোলাগে। এর ফলে অনেকেই শরণাপন্ন হচ্ছেন চিকিৎসকের।
চুলের চিকিৎসায় তাঁর নাম এক ডাকে চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা বোধহয় কমই আছে। তাঁর ক্লায়েন্টদের তালিকায় রয়েছেন একাধারে খেলোয়াড় থেকে রুপোলি জগতের অভিনেতারা। রয়েছেন নানা ক্ষেত্রের সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ। এঁরা সকলেই চুলের সমস্যা নিয়ে কোনও না কোনও সময়ে হাজির হয়েছেন মনোজ খান্নার চেম্বারে। তাঁর থেকেই এবার জেনে নেওয়া যাক হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়াটির বিষয়ে।
চুল পড়ে যাওয়া কিংবা টাক পড়ার সমস্যা কেন হয়?
সত্যিই এখন পুরুষদের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা টাক পড়ে যাওয়া। মহিলাদের ক্ষেত্রে চুল পাতলা হয়ে যাওয়া খুব কমন। ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে এর জন্য দায়ী জিন। মা- বাবা কিংবা ঠাকুমা-ঠাকুরদাদা বা দিদা-দাদুর চুলের ঘনত্ব এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চুল পড়ে যাওয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর বর্তায়। তিন বংশ অবধি জিন প্রভাব ফেলতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের উপর। ৩ শতাংশ মানুষের চুল পড়ে যাওয়ার কারণ নির্ভর করে রোগের উপর। যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কোভিড, টাইফয়েড বা কেমো থেরাপি নেওয়ার কারণে চুল পড়ে যায়। চুল পড়ে যায় সিগারানেমিয়া বা শরীরে ভিটামিনের অভাবেও।
এর প্রাথমিক চিকিৎসা কী ?
চিকিৎসা করতে গেলে প্রথমে ওষুধের সাহায্যে চেষ্টা করা হয় চুলের স্বাভাবিক ঘনত্ব ফিরিয়ে আনার। কিন্তু তাতে ফল না মিললে সার্জারি করতে হয়।
চুল পড়ে যায় মাথার সামনে বা মাঝখান থেকে। মাথার পিছনের অংশের চুল কখনও পড়ে না। পিছন দিকের চুল সারাজীবন থাকে এবং চুল প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা এই চুলই লাগিয়ে দিই। তা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে যাঁদের চুল পড়ার ক্ষেত্রে বংশগত কারণ দায়ী থাকে, তাঁদের সার্জারি করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।
প্রধানত দুটো ওষুধ কাজ করে হেয়ার লসে। তার মধ্যে একটি ওষুধ মিনক্সিল ফিনারাসাইড, যা চুল পড়া বন্ধ করে, চুলের সৌন্দর্য বাড়ায়। কিন্তু নতুন চুল গজায় না। দ্বিতীয়টি হল পিআরপি, যা করলে লাভ হয়, তাতে চুল যা আছে তা স্থায়ী হবে।
ওষুধে কাজ না হলে তবেই কি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়?
হ্যাঁ এর পরের ধাপই হল হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট। এক্ষেত্রে ইঞ্জেকশন দিয়ে অবশ করে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। অজ্ঞান করা হয় না। টিভি দেখতে দেখতে অথবা গান শুনতে শুনতে আপনি চিকিৎসা করাতে পারবেন। মাঝে টি-ব্রেক হবে, লাঞ্চ-ব্রেক হবে। তারপর আবার শেষ পর্যায়ের চিকিৎসার পর রোগী হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কিংবা কর্মক্ষেত্রেও ফিরে যেতে পারবেন।
অনেকে আবার, বিশেষত যাঁরা বিদেশ থেকে আসেন, তাঁরা হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের মধ্যেই ছোট ছোট ব্রেক-এ অনলাইন মিটিং বা অফিসের অন্য কোনও কাজ সেরে নিতে পারেন। কাজেও ফিরে যেতে পারেন হয়ে গেলেই। অনেক চিকিৎসকই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করার পর হাসপাতালে ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন এমনও হয়েছে। অনেকে আবার ট্রান্সপ্লান্টের ১ কিংবা ২ ঘণ্টা পর বা সেই রাত্রেই ফিরে গেছেন দুবাই কিংবা সিঙ্গাপুরে।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করার পদ্ধতিটা ঠিক কেমন?
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টে মাথার পিছনের চুল গোড়া সমেত তুলে নেওয়া হয় এবং তা মাথার সামনে বা মাঝখানের ফাঁকা অংশে ছোট ছোট ছিদ্র করে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই চুল আজীবন থাকবে। চুল বড় হবে, লম্বা হবে, কাটাও যাবে। স্বাভাবিকভাবে এই চুল আঁচড়ানো, শ্যাম্পু করা, তেল লাগানো সবই সম্ভব। সম্পুর্ণভাবে স্বাভাবিক চুল বলতে যা বোঝায়, সেভাবেই বেড়ে ওঠে এই চুল। এর জন্য আলাদা করে কোনও রক্ষণাবেক্ষণের দরকার হয় না। হেয়ার ডাই করতে পারেন, যেমন খুশি কাটতে পারেন, পছন্দের হেয়ারস্টাইল করতে পারেন। এক কথায় বলা যায়, স্বাভাবিক চুলের ক্ষেত্রে আমরা যা যা করি, তা সবই করা সম্ভব হয়। দুটো পদ্ধতিতে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। যে-কোনও পদ্ধতি রোগীরা বেছে নিতে পারেন।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করার কি কোনও বয়সসীমা আছে?
এই পদ্ধতিতে নেই কোনও বয়সের বাধা, না আছে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ফলে মাথা ফাঁকা হতে থাকলে মনখারাপ নয়, মাথা ভরা চুল আর মুখে হাসি নিয়ে দিব্যি ফিরতে পারবেন বাড়িতে। রোগীদের অনেকে চুল পড়ে যাওয়ার পর খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের পর তাঁরা হারানো মনোবল ফিরে পেয়েছেন। চেহারা অবশ্যই ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট চেহারায় পরিবর্তন আনে। নিজেকে আবার তরুণ মনে হয়।