• facebook
  • twitter
Friday, 11 April, 2025

ব্লাড ক্যান্সারের কারণ ও চিকিৎসা

অ্যাডভান্সড স্টেজ হলেও সঠিক চিকিৎসায় লিউকেমিয়া সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। এমনকী মাইলোমা রোগকেও নিয়ন্ত্রণ করে বহু বছর রোগীকে ভালো রাখা যায়। এমনটাই জানালেন ড. রাজীব ভট্টাচার্য, কনসাল্ট্যান্ট মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট, পিয়ারলেস হাসপাতাল।

ব্লাড ক্যান্সার কী এবং এর লক্ষণগুলি কেমন?

রক্তের ক্যান্সার রক্তকণিকা তৈরি ও কাজ করার ক্ষমতাকে বাধা দেয়। বেশিরভাগ রক্তের ক্যান্সার অস্থিমজ্জায় শুরু হয়, যেখানে রক্ত তৈরি হয়। এখানে স্টেম সেল থেকে তিন ধরনের রক্তকণিকা তৈরি হয়- লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেট। রক্তের ক্যান্সারের কারণে অস্বাভাবিক রক্তকণিকা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিক রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া নষ্ট হয়। এই অস্বাভাবিক কণিকাগুলো রক্তের স্বাভাবিক কাজ, যেমন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই বা রক্তপাত বন্ধ করাকে বাধাগ্রস্ত করে।

রক্তের ক্যান্সারের তিনটি প্রধান ধরন হল-

লিউকেমিয়া: এটি এক ধরনের রক্ত ও অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। এতে অস্বাভাবিক শ্বেত রক্তকণিকা খুব দ্রুত তৈরি হয়। এই কণিকাগুলো সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না, একইসঙ্গে অস্থিমজ্জাকে লোহিত রক্তকণিকা ও প্লাটিলেট তৈরি করতে বাধা দেয়।

লিম্ফোমা: এটি মূলত লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে হওয়া একটি রক্তের ক্যান্সার। লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম শরীর থেকে বাড়তি তরল সরিয়ে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। লিম্ফোসাইট নামের শ্বেত রক্তকণিকা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লিম্ফোমা হলে, এই লিম্ফোসাইটগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে লিম্ফ নোড ও অন্যান্য টিস্যুতে জমা হয়। ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

মাইলোমা: এটি প্লাজমা কোষের ক্যান্সার। প্লাজমা কোষ শ্বেত রক্তকণিকার একটি অংশ, যা রোগ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরি করে। মাইলোমা হলে, এই কোষগুলো অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও মাইলোমায় হাড়ে লিটিক লেশন্স তৈরি হয়, যার ফলে হাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়।

কোন পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ সনাক্ত হয়?

বিভিন্ন ব্লাড ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন, লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ একটি ব্লাড কাউন্ট টেস্ট লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেটের অস্বাভাবিক মাত্রা সনাক্ত করতে পারে। এর পর অস্থিমজ্জা অ্যাসপিরেশন ও বায়োপসি করতে হয়- যাতে সঠিকভাবে লিউকেমিয়ার চরিত্র নির্ণয় করা যায়। অস্থিমজ্জা থেকে নেওয়া রস বা টিস্যুর বিভিন্ন পরীক্ষা, যেমন ফ্লো সাইটোমেট্রি বা জিন টেস্টিং করে এটি বের করা হয়।

লিম্ফোমার ক্ষেত্রে বায়োপসি করতে হয়, যেখানে টিস্যুর একটি ছোট অংশ নেওয়া হয় এবং মাইক্রোস্কোপের নিচে সেটা পরীক্ষা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে, ফোলা লিম্ফ নোড সনাক্ত করতে এক্স-রে, সিটি (CT) বা পিইটি (PET) স্ক্যান করতে হতে পারে।

মাইলোমার ক্ষেত্রে সিবিসি (CBC) বা অন্যান্য রক্ত ও প্রস্রাবের টেস্ট করা হয়, যাতে মাইলোমার কারণে তৈরি হওয়া রাসায়নিক বা প্রোটিন সনাক্ত করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে, অস্থিমজ্জার বায়োপসি, এক্স-রে, এমআরআই (MRI), পিইটি (PET) এবং সিটি (CT) স্ক্যান- মাইলোমার উপস্থিতি এবং এর বিস্তারের পরিমাণ নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়।

কোন স্টেজে সনাক্ত হলে এই অসুখে নিরাময় সম্ভব?

ব্লাড ক্যান্সারের মধ্যে লিউকেমিয়া এবং মাইলোমার ক্ষেত্রে তথাকথিত স্টেজিং বলতে আমরা যা বুঝি, তা হয় না। কারণ এই দুই রোগেই ক্যান্সারের কোষ রক্তের মধ্যে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাই সবই অ্যাডভান্স স্টেজ বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, রোগটির অ্যাডভান্সড স্টেজ হলেও সঠিক চিকিৎসায় লিউকেমিয়া সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। মাইলোমা অনেকটা ক্রনিক রোগের মতো কিন্তু সঠিক চিকিৎসা করলে রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে বহু বছর রোগীকে ভালো রাখা যায়।

লিম্ফোমাকে বিভিন্ন স্টেজে ভাগ করা যায়। কিন্তু সব স্টেজেই লিম্ফোমা নির্মূল করা সম্ভব। তবে এটা সত্যি যে প্রাথমিক স্টেজের লিম্ফোমা সারিয়ে তোলা অনেক বেশি সহজ।

এর জন্য রোগীকে কী চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়?

লিউকেমিয়া চিকিৎসা রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য অবস্থা, লিউকেমিয়ার ধরন (অ্যাকিউট বা ক্রনিক) এবং স্টেজের উপর নির্ভর করে। প্রধান চিকিৎসাগুলো হল কেমোথেরাপি, যা ক্যান্সার সেল ধ্বংস করে, টার্গেটেড থেরাপি, যা নির্দিষ্ট প্রোটিন বা জিনকে টার্গেট করে এবং রেডিয়েশন থেরাপি, যা হাই-এনার্জি রশ্মির মাধ্যমে ক্যান্সার সেল নষ্ট করে। স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সেল প্রতিস্থাপন করা হয় সুস্থ স্টেম সেল দিয়ে। ইমিউনোথেরাপি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে বুস্ট করে ও লিউকেমিয়া সেলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। অ্যাকিউট লিউকেমিয়ায় তীব্র চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, কিন্তু ক্রনিক লিউকেমিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং হালকা চিকিৎসাই প্রয়োজন হয়। সময়মতো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
লিম্ফোমার চিকিৎসাও করা হয় কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনো থেরাপির সাহায্যে। রেডিয়ো থেরাপি অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয়। রোগ ফিরে এলে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হয়।

মাইলোমার ক্ষেত্রে একাধিক নতুন ওষুধ রয়েছে যার প্রয়োগে রোগী অনেকদিন ভালো থাকে। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করে মাইলোমাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব।

CAR T-cell থেরাপি ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় একটি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি। এই মেথডে, রোগীর টি-সেলগুলোকে ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক মডিফিকেশন করে ‘Chimeric Antigen Receptor (CAR)’ যুক্ত করা হয়। এই মডিফাইড টি-সেলগুলো নির্দিষ্ট ক্যান্সার সেলকে টার্গেট করে ধ্বংস করতে পারে। CAR T-cell থেরাপি প্রায়ই লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং মাইলোমার মতো ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে অন্যান্য প্রচলিত চিকিৎসা কাজ করে না। এটি ক্যান্সার সেল ধ্বংসের সম্ভাবনা বাড়ায় এবং রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে একরকম ‘কাস্টমাইজড’ অস্ত্রের মতো কাজে লাগায়। এটি যেন ব্লাড ক্যান্সারের উপর সার্জিকাল স্ট্রাইক।

নিরাময়ের পর রোগী কি এই রোগে পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন?

রক্তের ক্যান্সার চিকিৎসার পর আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা, অনেক কিছুতে নির্ভর করে। যেমন ক্যান্সারের ধরন, এটা কোথায় ছড়িয়েছে, চিকিৎসার ফলাফল এবং রোগীর স্বাস্থ্য। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া (ALL) এবং অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (AML)-এর রিল্যাপ্স হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিশেষ করে চিকিৎসার পর প্রথম কয়েক বছরে। এই ধরনের ক্যান্সার ১৫%-৫০% পর্যন্ত আবার ফিরে আসতে পারে। ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (CML) যদি সঠিক চিকিৎসা, যেমন ইমাটিনিব দিয়ে হয়, তবে রিল্যাপ্সের ঝুঁকি কম থাকে।

লিম্ফোমা, যেমন হজকিন্স এবং নন-হজকিন্স লিম্ফোমা- এর রিল্যাপ্সের হার ১০%-৫০% এর মধ্যে হতে পারে, যা ক্যান্সারের স্তর এবং ধরন অনুযায়ী বদলে যায়। মাইলোমা, যা সাধারণত সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, প্রায়ই রিল্যাপ্স করে। তবে চিকিৎসা চালিয়ে গেলে রোগী অনেক দিন ভালো থাকতে পারে। ক্যান্সারের ধরন, চিকিৎসার পর কিছু রোগ রয়ে গেছে কিনা (মিনিমাল রেসিডুয়াল ডিজিজ বা MRD) এবং ক্যান্সার সেলগুলোর মধ্যে কোনও জেনেটিক পরিবর্তন হয়েছে কিনা, এই বিষয়গুলি রিল্যাপ্সের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে। নিয়মিত চেক-আপ, রিল্যাপ্সের প্রথম লক্ষণ দেখা এবং সুস্থ জীবনযাপন- রিল্যাপ্সের ঝুঁকি কমাতে এবং সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।