৮ শতাংশ অসুস্থতা যখন লজ্জায় ও অক্ষমতায়

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সবচেয়ে কম অগ্রাধিকার পাওয়া একটি ‘স্ত্রী-রোগ’৷ অথচ একটি সুস্থ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীর যৌন স্বাস্থ্য৷ কিন্ত্ত নারীর সব স্বাস্থ্যসেবা আটকে আছে গর্ভকালীন নয় মাসে৷ দেশ-বিদেশে এখনও স্ত্রী-রোগগুলোকে অত্যন্ত গোপনীয় ও লজ্জার বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ ফলে তারা অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা এমনকি শারীরিক অক্ষমতায় ভুগলেও চিকিৎসকের শ্মরণাপন্ন হন না৷ আবার অনেকে হাসপাতালে গেলেও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন৷

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের অ-ক্যানসারজনিত স্ত্রী-রোগে এক কোটি ৪৫ লাখ বছর নষ্ট হয় (ইয়ারস লস্ট ডিউ টু ডিজএবিলিটি)৷ যা কি না নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বসবাসকারী নারীদের জীবনের ৮ শতাংশ এবং উন্নত দেশে বসবাসকারী নারীদের জীবনের ৪ শতাংশ সময়৷ ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১৫-৪৯ বছর বয়সী (৪ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৭ জন) নারীরা বিভিন্ন স্ত্রী-রোগে ভোগার কারণে মোট ৩ লাখ ৯২ হাজার ৯৪৪ জন বয়সের অসামঞ্জস্য বা অসমতায় পার করে (ডিজএবেলিটি অ্যাডজাস্টেড লাইফ ইয়ার)৷ সংস্থাটি জানায়, একটোপিক প্রেগনেন্সি অথবা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণের কারণে ১ হাজার ৯৩৭ জন, এন্ডোমেট্রিওসিসে ৫০ হাজার ৬৮৬ জন, স্ত্রী বন্ধ্যাত্বে ১০ হাজার ৭৫০ জন, জেনিটাল প্রোল্যাপস বা  জরায়ু নিচে নেমে আসার কারণে ৭ হাজার ৫৫৮ জন, গর্ভপাত ও গর্ভনষ্টে ৮ হাজার ৬৬৭ জন, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে (পিসিওএস) ৪ হাজার ২৮৭ জন, জরায়ুর টিউমারে ১৬ হাজার ৮২ জন, পেলভিক প্রদাহজনিত রোগে (গনোরিয়া, ক্লামিডিয়া, ট্রাইকোমোনিয়াসিস) ৫ হাজার ৩৯৪ জন এবং অন্যান্য অ-ক্যানসারজনিত স্ত্রীরোগে নারীদের ২ লাখ ৮৭ হজার ৫৮৪ জন বছর অসামঞ্জস্য বা অসমতায় নষ্ট হয়৷

সেব্রিনা ফ্লোরা, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মতো উন্নতশীল দেশেও স্ত্রী-রোগকে লজ্জাজনক ও গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এ সংক্রান্ত বিষয় মা-মেয়ের মাঝে আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ৷ গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে স্ত্রী-রোগের প্রভাব সবচেয়ে বেশি৷ রোগ গুরুতর পর্যায়ে না গেলে নারীরা চিকিৎসার জন্য আসছেন না৷ অপরদিকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে তারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ এতে নারীর জীবনযাত্রার মানও আর্থিকভাবে মারাত্বক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷


রোগের কথা লজ্জায় না বলার কারণে শুধু যে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় এমন নয়, মানসিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ এটা আমাদের দেশে কাজ করার বড় একটি জায়গা৷ আমরা তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি, তারা যেন গোপন না করেন৷ প্রয়োজনে তারা যেন চিকিৎসকের কাছে আসেন৷ ডা. ফ্লোরা বলেন, ‘আমাদের মতো কনজারভেটিভ দেশে সাংস্কৃতিক কিছু বাধাও কাজ করে৷ যেমন মহিলা চিকিৎসক না হলে নারীরা যেতে চায় না৷ এখন নারী চিকিৎসক বাড়ছে, মেয়েরা পড়াশোনা করে সচেতন হচ্ছে৷ ফলে এটা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আশা করি৷ তবে এখনো আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, গ্রামের মানুষেরা চিকিৎসা নিতে কিছুটা কম আসেন৷ ডেঙ্গুর মতো একটা রোগে অধিকসংখ্যক পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্ত্ত মৃতু্য বেশি নারীদের মধ্যে৷ এর কারণ হয়ত তাদের যখন চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তখন আসেনি৷ দেরিতে আসায় তাদের বাঁচানো যায়নি৷

ক্ষতির কথা জানিয়ে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, ‘জীবনযাত্রার মানের পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিকভাবেও প্রভাব ফেলছে৷ তবে এখনো আমাদের অর্ধেকের বেশি নারী প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেন না৷ বাইরের দেশের তুলনায় আমাদের কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কম৷ যেকোনো অসুস্থতাই অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে৷ একটা চিকিৎসা খরচ হিসেবে, অপরটি কর্মঘণ্টা নষ্টের মাধ্যমে৷’

লজ্জা ভাঙা ও চিকিৎসার সুযোগের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে অনেক কাজ হচ্ছে৷ কিন্ত্ত সেখানেও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব আছে৷ আমাদের এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে সব পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি৷ নারীদের প্রথমে লজ্জা মনে না করে এটিকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে৷’

এই ৯ মাসের আগে এবং পরের যে সময়টা তখনকার অসুস্থতা নিয়ে আমরা আলোচনা করি না৷ কিন্ত্ত এগুলোকে লুকিয়ে রাখা যাবে না৷ গর্ভের সময়ের বাইরের স্ত্রী-রোগগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে৷ যেমন অনেকে মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অজ্ঞান হয়ে যায়, অনেক সময় এটা নিয়ে হয়ত কানাঘুষা হয়, কিন্ত্ত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় না৷ যোনী নিচে নেমে আসা (জেনিটাল প্রোলাপস) কিংবা ফিস্টুলার সমস্যার কারণে অসংখ্য নারী পারিবারিক এবং দাম্পত্য জীবনে অবহেলার শিকার হয়, এমনকি অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে যায়৷ যে ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলা হয় না৷’

এই গবেষক বলেন, ‘পিসিওএস-এ আক্রান্ত একজন নারী নানাবিধ শারীরিক কষ্টে ভোগে৷ হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া, শরীরে লোম বেড়ে যাওয়ার সাথে আরও নানাবিধ সমস্যার সূত্রপাত হচ্ছে৷ অথচ এ সমস্যা নিয়ে তারা চিকিৎসকের কাছে যায় না৷ অনেক সময় এ বিষয় নিয়ে মা-মেয়ে কিংবা পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের সাথে গোপনে আলোচনা করতে দেখা যায়৷ এই গোপনীয়তার চর্চা ভাঙতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে৷