মুম্বাই ,১৪ ফেব্রুয়ারি — বাংলোর প্রহরীর কাছে যোগিতা জানতে পেরেছিলেন, সেখানে সাহেবের সঙ্গে আরও একজন মেমসাহেব আসেন এবং মাঝেমাঝে রাতে থেকেও যান। যোগিতা বালি একথা শুনেছিলেন মিঠুনের বাংলো মাড আইল্যান্ডের প্রহরীর কাছে। আর এটাই ছিল শ্রীর প্রেম ভাঙার জন্য যথেষ্ট।
মিঠুন তখন যোগিতার সঙ্গে বিবাহিত। কিন্তু প্রেমে পড়েছেন সহ অভিনেত্রী শ্রীদেবীর। আর লুকিয়ে দুজনেই বাংলোয় যেতেন। একথা এই শুনেই যোগিতা সঙ্গেসঙ্গে বাংলো থেকে মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিলেন। সন্ধ্যের পরেও যখন যোগিতা ঘরের দরজা খুলছিলেন না, তখন আবাসনের কোনও এক বাসিন্দা দরজা ভেঙে যোগিতাকে উদ্ধার করেছিলেন অচৈতন্য অবস্থায়। ডাক্তার বলেছিলেন, ‘অতিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন যোগিতা।’
এমনই ছিল মধ্য আশির দশকেমিঠুন-শ্রীদেবীর প্রেমের ইতির গল্প। বলিউডের অন্যতম সাড়া জাগানো রোমান্স উপাখ্যান যা এক অধরা প্রেম কাহানি হয়ে রয়ে গিয়েছিল। আজকের মহাগুরু, তখনকার ডিস্কো ডান্সার মিঠুন চক্রবর্তী আর প্রেমিকাটি ছিলেন দক্ষিণের খাজুরাহো ‘হাওয়া হাওয়াই’ গার্ল শ্রীদেবী। শ্রীদেবী ও মিঠুনের প্রেমের সূত্রপাত ‘জাগ উঠা ইনসান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালে রাকেশ রোশন পরিচালিত এই সিনেমায় প্রধান তিন ভূমিকায় ছিলেন শ্রীদেবী, মিঠুন চক্রবর্তী এবং রাকেশ রোশন। ছবিটি সমালোচকমহলে প্রশংসিত ও দর্শকমহলেও বিপুল হিটও হয়।এই সিনেমার সেটেই রিল লাইফের প্রেম মিলে যায় রিয়েল লাইফে। প্রথম দেখাতেই শ্রীদেবী ও মিঠুন দুজন দুজনকে মন দিয়ে ফেলেন। দর্শকমনেও তখন নতুন প্রজন্মের কাছে শ্রীদেবী-মিঠুন জুটির চাহিদা তুঙ্গে। দুজনেই যেন আদর্শ জুটি। শ্যুটিং করতে করতে দুজন দুজনের আরও কাছাকাছি চলে আসেন। এমনকি প্রেম এতদূর গড়ায় যে শ্যুটিং এর মাঝেই একদিন মিঠুন শ্রীদেবীকে প্রোপোজ করে বসেন এবং শ্রীদেবী হ্যাঁ-ও বলে দেন।
কিন্তু তখনই মিঠুন ছিলেন বিবাহিত। মিঠুন যখন বলিউডে পা রাখেন, তখন তাঁকে একরকম গড়ে তুলেছিলেন যোগিতা বালি। যোগিতা ছিলেন মিঠুনের থেকে বয়সে বড়। তাই যোগিতার অভিজ্ঞতাও বেশি। শুধু তাই নয় যোগিতা বালির আরও এক পরিচয় তিনি ছিলেন কিশোর কুমারের প্রাক্তন স্ত্রী। কিশোরের সঙ্গে ডিভোর্সের পর মিঠুনকে বিয়ে করেন যোগিতা। যদিও মিঠুন যোগিতাকে বিয়ে করেন প্রথম স্ত্রী ‘জুদাই’ ছবির অভিনেত্রী হেলেনা লিউকইকে বিয়ের মাত্র ৪ মাস বিচ্ছেদ দিয়ে।
ইতিমধ্যে মিঠুনের সঙ্গে আলাপ হয় বনি কাপুরের। তখন শ্রীদেবী চিনতেন না বনিকে। এসময় বনি কাপুর প্রথম আসেন ইন্ডাস্ট্রিতে, প্রযোজক রূপে। বনির ‘হাম পাঁচ’ ছবিতে অভিনয় করার মাধ্যমে বনি আর মিঠুন খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠেন। মিঠুনই তাঁর প্রেমিকা শ্রীদেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বনি কাপুরের। তখন মিঠুন নিজেও জানতেন না, বনি-শ্রীদেবী বিয়ে করবেন আর মিঠুনের প্রেম ভেঙে যাবে।
ইতিমধ্যে ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় মিঠুনের ‘ডিস্কো ডান্সার’ ছবি। যে ছবি দিয়েই মিঠুন সুপারস্টার হয়ে যান এবং তাঁর হাতে চলে আসে অজস্র ছবি।
শ্রীদেবী কিন্তু প্রকাশ্যে কখনও মিঠুনকে নিয়ে মুখ খোলেননি। শ্রীদেবী তখন তাঁর বিয়ে নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি বিয়ে করব। কিন্তু বিয়ে করা কোনও পুরুষকে আমি কখনও বিয়ে করব না।’
অন্যদিকে বনি-শ্রীদেবী সখ্যতা বেশ ঘনীভূত হতে থাকে। বনি তাঁর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবির নায়িকার জন্য শ্রীদেবীকে চান। শ্রীদেবীও তখন নিজের দর বাড়াতে থাকেন। শ্রীদেবী তাঁর মাকে বলে দেন বনির ছবি করতে পারেন এক শর্তে, বনি যদি তাঁকে দশ লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক দেন। ওই সময় দশ লক্ষ টাকা ছিল অনেক অনেক বেশি।
শ্রীদেবীর মাও বনিকে এই কথা জানিয়ে দেন। বনি এতই শ্রীদেবীতে ফিদা ছিলেন যে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র জন্য দশ নয়, মোট এগারো লক্ষ টাকা দেন শ্রীকে। এরপর আর বনিকে ফেরায় কার সাধ্য।
এই সময়ই শ্রী-বনি ঘনিষ্ঠতা মিঠুনের চোখে লাগে। মিঠুন শ্রীকে আলাদা ডেকে বলেনও এ কথা। শ্রী বলেন, তাঁর আর বনির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নেই। কিন্তু মিঠুনের খটকা রয়েই যায়। তাই এক রাখীপূর্ণিমার দিনে মিঠুন সেটে শ্রীদেবীকে দিয়ে বনির হাতে রাখীও বাঁধিয়ে দেন। তবে সে রাখী আদতে ছিল ‘বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না’… মিঠুন বোঝেননি।
শোনা যায়, এক রাতের জন্য মিঠুন-শ্রীদেবী লুকিয়ে বিয়েও করেছিলেন হিন্দুমতে। পরদিন সকালেই শ্রীদেবী মিঠুনের কাছে ডিভোর্সের উকিলের চিঠি পাঠান নিজের ভুল বুঝতে পেরে। কারণ বিবাহিত লোকের সঙ্গে সুখী হওয়া যায় না। যদিও এই বিয়ের সত্যতা নিয়ে দ্বিমত আছে। অনেকেই বলেন মিঠুন এক সাক্ষাৎকারে তাঁর আর শ্রীদেবীর বিয়ে হয়ে গেছে জানিয়েছেন।
মিঠুন-শ্রীদেবী প্রেম ভেঙে গিয়েছিল মূলত যোগিতা বালির প্রতিরোধেই। যোগিতা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করায় আরও বেশি করে মিঠুন যোগিতার সংসারে ফিরে আসেন। কিন্তু কিছুজন বলেছিলেন, যোগিতার এই আত্মহত্যা অনেকটাই ছিল তাঁর নাটক। স্বামীকে ধরে রাখতে যোগিতা আত্মহত্যার নাটক ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পাননি।
সে যাই হোক না কেন, এসময়ের পরে মিঠুন-শ্রীদেবীর প্রেম টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। শ্রীদেবী কারও ঘর ভাঙার কলঙ্কভাগী হতে না চেয়ে সরে আসেন। সই করা ছবিগুলোই শুধু দুজনে করেছিলেন। ‘গুরু’ ছবির শেষ দৃশ্যই ছিল মিঠুন-শ্রীদেবীর একসঙ্গে করা শেষ কাজ। শ্রীদেবী বলেছিলেন, তিনি চান না কারও ‘দুসরি অউরত’ হয়ে জীবন কাটাতে। অথচ আদতে শ্রীকে বাকি জীবন দুসরি অউরত হয়েই কাটাতে হল।
মিঠুনের বিরহে শ্রীদেবী মায়ের সঙ্গে চলে যান আমেরিকায়। সেখানে শ্রীদেবীর মা অসুস্থ হয়ে পড়লে বনিও ছুটে যান আমেরিকায় এবং সব দায়িত্ব নেন। তাতেই বনির প্রতি মন গলে যায় শ্রীদেবীর। আবারও সেই বিবাহিত লোককেই মন দিয়ে বসেন শ্রী।
১৯৮৩ সালে মোনা সৌরির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বনি কাপুরের। সেটা ছিল অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে বনি আর শ্রীদেবী সাত পাকে বাঁধা পড়েন। বনি তেরো বছরের বিবাহিত জীবনে স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে চলে আসেন শ্রীদেবীর কাছে। তাঁদের দুই কন্যা সন্তান-জাহ্নবী আর খুশি। আমৃত্যু বনির সঙ্গে সুখে সংসার করেছেন শ্রীদেবী।
শ্রীদেবীর মাত্র চুয়ান্ন বছরের প্রয়াণে মিঠুন কতটা আঘাত পেয়েছিলেন তা জানা যায়নি।