জানেন কি ভোজপুরি আসলে কোন ভাষার আধার? ভোজপুরি নিয়ে নিয়ে বিশ্বাস ও মত আছে। যথেষ্ট প্রাচীন এই ভাষা। কিন্তু মানুষ বা অন্য জীবের মতো ভাষাও মরে যায়। বহু বিশেষজ্ঞেরই আশঙ্কা আগামী একশো বছরে নাকি নব্বই শতাংশ ভাষা মারা যাবে! হয়তো এমন দাবিতে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে। কিন্তু শতাংশের হিসেবটা যদি কমও হয়, তাহলেও মানতেই হবে পরিস্থিতি যথেষ্ট বিপজ্জনক। বাংলা ভাষার ভবিষ্য়ৎও যে খুব সুরক্ষিত নয়, তাও বলাই বাহুল্য।
তবে ভোজপুরির ক্ষেত্রে বলার অভাব নয় এভাবে বলাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে ভোজপুরীর একটা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে ওই ধরনের গানের সূত্রে। ফলে শিক্ষিত ভোজপুরী ভাষাভাষী মানুষরা আর সেই ভাষায় কথা বলছেন না। হিন্দি বা অন্য কোনও ভাষায় কথা বলা শুরু করছেন। আশঙ্কা, এমনটা চলতে থাকলে ভোজপুরী ভাষা মূলত অশিক্ষিত ও কর্মহীন মানুষের মুখের ভাষা হয়েই থেকে যাবে।
এমন নয়, শিক্ষিতরা ভোজপুরী গান শোনেন না বা কিংবা উপভোগ করেন না। গানের ‘বিট’ তাঁদেরও মজা দেয়। পার্টিতে কোমরও দুলে ওঠে। গানের ‘রসাল’ লিরিক্স নিয়ে চর্চা করে বন্ধুমহলে। কিন্তু বিষয়টা ওখানেই থেমে যায়। ভোজপুরী ভাষার আর কোনও অস্তিত্ব তাঁদের জীবনচর্চায় নেই। ফলত ক্রমশই ওই বিশেষ ধরনের গানের চারপাশেই যেন বাঁধা পড়ে যাচ্ছে ভোজপুরী ভাষা। বিপন্ন হচ্ছে তার অস্তিত্ব।
আচ্ছা আমরা যে বলছি ভোজপুরি হারিয়ে যাচ্ছে অশ্লিলতার দায়ে, তাহলে হিন্দি কি বাঙালি অশ্লীল গান নেই ? বলিউডে ‘চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়’, ‘সরখাইলে খাটিয়া’ কিংবা ‘অঙ্গনা মে বাবা’র মতো গানের অভাব নেই। আবার টালিগঞ্জেও ‘যতই ঘুড়ি ওড়াও রাতে’, ‘লুচি লুচি ফুলকো লুচি’র মতো গান অনেক পাওয়া যাবে। প্রায় সব ভাষার গানেই নারীকে ‘যৌন বস্তু’ হিসেবে দেখানো হয়। নরনারীর প্রেমকে কেন্দ্র করে ইঙ্গিতবাহী শব্দ ব্যবহার করে শরীরী মিলন কিংবা নারী, পুরুষের গোপনাঙ্গের বর্ণনাও আকছার মেলে। কিন্তু ভোজপুরীর ক্ষেত্রে মারাত্মক ফলটা হচ্ছে কারণ এখানে অশ্লিলতা রন্ধে-রন্ধে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে।
রোজকার ব্যবহৃত জিনিসের নাম ব্যবহার করে নারীর (এমনকী পুরুষেরও) গোপনাঙ্গের ইঙ্গিত বহন করা হচ্ছে। ফলে একবার শুনলেই পুরোটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাছাড়া গায়কী ভঙ্গিতেও কার্যতই কামার্ত একটা স্বর ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে সুরের চটক ও কথার গমকের দুরন্ত রসায়ন খুব দ্রুত শ্রোতাকে বশ করে ফেলে।
মূলত একটি স্থানিক ভাষা হয়েও ভোজপুরীর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পিছনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান কম নয়। আর এই ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ভোজপুরী গানগুলিও। ফলে সামগ্রিক ভাবেই ‘ভোজপুরী সংস্কৃতি’ বললে এই চটক আর যৌন ইশারার কথাই বোঝে সকলে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াচ্ছে, গানগুলির জনপ্রিয়তাতেই ভোজপুরী ভাষা বিপণ্ণ হয়ে পড়ছে। তেমনটাই দাবি ওয়াকিবহাল মহলের।
পুরাণ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস কিংবা ব্রিটিশরাজ অথবা নকশাল আন্দোলন- ভোজপুরী অধ্যুষিত ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা অধ্যায়ের সাক্ষী। কিন্তু সময়ের নিয়মই হল বিস্মৃতি।
তবে শুধুই ‘শরীর’ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে না গেলে এই ভাষাকে বাচায় কার সাধ্যি।