কেকা সিং ঢালী
ফিল্ম জগতে এমন অনেক অভিনেতা আছেন যারা নিজের অভিনয় দক্ষতার থেকেও বেশী জনপ্রিয় তাদের ব্যাক্তিত্ব ও অভিনেতা সুলভ চেহারার জন্য । এরকম অভিনেতারা যে কোনো চরিত্রে পর্দায় আসুন না কেনো, নিজেদের একটা আলাদা ছাপ ফেলে যান দর্শকদের মনে। এমনই একজন অভিনেতা ছিলেন ইন্দর কুমার। যিনি কখনও লিড রোল তো কখনও সাপোর্টিং রোলে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন। তাঁকে দেখে দর্শকদের মনে হয়েছিল তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া কিন্তু খুব অল্প সময়েই থেমে যায় তাঁর দৌড়। একটা দুর্ঘটনায় ইন্দোরের রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফ দুটোই শেষ করে দেয়। যদিও সেই দুর্ঘটনার তিনি আবার উঠে দাঁড়ান কিন্তু কয়েকবছর পরে ই ওনার মৃত্যু হয়ে যায়।
কোন দুর্ঘটনার পর ইন্দর কুমারের ফিল্মি ক্যারিয়ার নষ্ট হয় এবং কি করে হলো ওনার মৃত্যু । কি এমন ঘটেছিল যার জন্য অল্প বয়সে ওনার এই করুন পরিস্থিতি ।আসুন জেনে নেওয়া যাক।
২৬ শে আগস্ট ১৯৭৩ জয়পুরের এক মারোয়ারী পরিবারে ইন্দরের জন্ম। পুরো নাম ইন্দর কুমার সারাফ।
পরবর্তীতে ইন্দরের পরিবার মুম্বাইতে শিফট হয়ে যায় ।ইন্দরের পড়াশোনা পুরো হয় সেন্ট জেভিয়ার্স হাইস্কুল ও বল্লভ ভাই পাটেল স্কুল থেকে। ইন্দোরের বরাবরই অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে ছিল। আর এইসময় তার সাক্ষাৎ হয় রাজু কারিয়ার সঙ্গে। তিনিই ইন্দোরের ক্যারিয়ার প্রথম শুরু করেন বিভিন্ন পরিচালকদের সাথে পরিচয় করিয়ে।
ইন্দরের ফিল্মি ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৬ এ মাসুম ছবি দিয়ে এই বইতে ওনার সাথে ছিলেন আয়েশা জুলকা ।যিনি সেই সময়ের বহুচর্চ্চিত অভিনেত্রী ছিলেন। এই ছবিটি দর্শকরা বেশ পছন্দ করেন। কিন্তু সেই সময় বলিউডে সেই সময় খান থেকে শুরু করে সুনীল শেঠি, অক্ষয় কুমারদের রাজত্ব। এদের সামনে নতুন কারুর বলিউডে পা রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। ইন্দরের নিজেকে নায়ক হিসাবে প্রমাণ করা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমের দিকে ইন্দর কয়েকটি ছবিতে লিড অ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেন । কিন্তু তাতেও যখন উনি সাফল্য পাননি তখন উনি হতাশ হয়ে পড়েন।
সেই সময় তার পরিচয় সলমন খানের সাথে হয় ।সলমন নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ওনাকে পরামর্শ দেন যে নিজের শারীরিক গঠনের ওপর কাজ করতে এবং বডি বানিয়ে আসতে। সালমান ইন্দরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেন। ইন্দর বডি বানিয়ে আবার কামব্যাক করেন ।পরপর তিনি সলমনের সাথে বেশ কয়েকটি ছবি করেন, এছাড়াও ওনাকে অনেক ছবিতে দেখা যায় যেমন ঘুঙ্ঘট, গজগামিনি, খিলারিও কা খিলাড়ি, কুয়ারা, দন্ডনায়াক, কঁহি পেয়ার না হো যায় ইত্যাদিতে ।
কিন্তু এত ছবি করার পরেও ইন্দর সেই সাফল্য পাচ্ছিলেন না যেটা ওনার দরকার ছিল। তাই তিনি টিভি সিরিয়ালের দিকে পা বাড়ান। সেই সময় জনপ্রিয় টিভি শো কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি তে মিহিরের চরিত্রে ভালো অভিনয় ও কিছু ভালো ছবিতে অভিনয় থেকে ওনার ক্যারিয়ার গ্রাফ সত্যিই উঠতে শুরু করে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে হঠাৎ সব কিছু থেমে যায়, ২০০২ সালে যখন মাসিহা ছবির শুটিং এর সময় একটা ভয়ঙ্কর স্টান্ট করতে গিয়ে হেলিকপ্টার থেকে পড়ে যান তিনি। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ইন্দর। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন ৩ বছর বেডরেস্টের । এমনকি চিকিৎসকরা এও বলেন যে উনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে । ইন্দরের বলিউডের যাত্রা এখানেই থেমে যায় এবং ফিল্ম জগৎ থেকে দূরে সরে যেতে হয় তাঁকে । কিন্তু এতো কিছুর পরও তিনি হার মানেন নি। টানা ৩ বছর লড়াইয়ের পর তিনি নিজের পায়ে দাড়ান ।আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালান ইন্দর ।২০০৫ সালে বাঙালি ছবি অগ্নিপথ রিলিজ হয়, তারপর আরয়ান, ও পেইন গেস্ট এর মত হিন্দি ছবিতে কাজ করেন । কিন্তু এই ছবিগুলো না চলায় ইন্দরের তেমন কোনও লাভ হয়নি । এরপর ২০০৯ সালে সলমনের ওয়ান্টেড ছবিতে সলমনের বন্ধু চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে, ছবি তে ওনার চরিত্র প্রশংসা পেলেও তেমন কোনো ভালো কাজের সুযোগ পাচ্ছিলেন না বলিউড থেকে ।
মিডিয়া রিপোর্টের অনুসারে বিগবস থেকেও ইন্দরের কাছে অফার এসছিল। কিন্তু সলমন ওনাকে এই শোতে যেতে বারণ করেন ওনার খারাপ শারীরিক অবস্থার জন্য। নিজের ক্যারিয়ারের এই খারাপ সময়ে এমন বাজে দিনও গেছে যেখানে ইন্দর কাজের জন্য কোনো পরিচালক কে ফোন করলে তার ফোন নাম্বার ব্লক করে দেওয়া হতো। কথায় আছে ভগবান যখন কাউকে দেন তখন তার ঝুলি ভরে দেন আর ঠিক তার বিপরীতে যখন ভাগ্য খারাপ হয় তখন শত চেষ্টাও বিফল হয়। এই সবের পরে তিনি নানা কন্ট্রোভার্সিতে জড়িয়ে পড়েন। ওনার ওপর ড্রাগ নেওয়ার অপবাদ তো ছিলই। ২০১৪ সালে ওনাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। যদিও তিনি কিছুদিন পরেই ছাড়া পেয়ে যান। নিজের এক ইন্টারভিউ তে তিনি জানান, গ্রেফতারির পর ওনার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে তাদের কাছে ঘরের ভাড়া দেওয়ার মত টাকা ছিল না। নিজের বন্ধুর বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন তারা। ইন্দরের নিজের বেল করবার মত টাকাও ছিল না । সেই সময় ইন্ডাস্ট্রির কেউ সাহায্য করেন নি । একমাত্র ডলি বিন্দ্রা সেই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । ধর্ষণে অভিযুক্ত হবার পর তার ক্যারিয়ার পুরো নষ্ট হয়ে যায়। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার । অনেকের মতে এটি আত্মহত্যা ছিল । কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ওনার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকের কারণে হয়েছিল। মৃত্যুর পর ধর্ষণের মামলাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু ওনার স্ত্রী কোর্টে আর্জি জানান যাতে এই কেস বন্ধ না করা হয়।কারণ তিনি বলেন ইন্দরের ওপর লাগানো অভিযোগ মিথ্যে। সত্যি টা সবার সামনে আশা উচিত ।এবং ইন্দর ন্যায় বিচার পাবে।
মৃত্যুর কিছুদিন আগের একটি ভিডিও সোসিয়াল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল যেখানে ইন্দরকে আত্মহত্যার কথা বলতে দেখা যায় । তিনি আরও বলেন নিজের ভুলে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করেছেন, তার লাগামছাড়া জীবনযাত্রা তার এই করুন পরিস্থিতির কারণ। তাঁকে তাঁর মা বাবার কাছেও ক্ষমা চাইতে দেখা যায়। যদিও পরে বলা হয় ওই ভিডিওটি আসলে ছিল ছবির একটি সিন। পরে ওনার স্ত্রী পল্লবীও এটিকে তার ফিল্মের একটি সিন বলে ব্যাখ্যা করেন যেটি ওনার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই শুট করা হয়েছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া অনুসারে মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগেই ইনস্টাগ্রামে উনি নিজের ছবি দিয়ে একটি পোস্ট করেছিলেন যার নিচে লেখা ছিল peace। সবাই এটা ভেবে অবাক যে নিজের মৃত্যুর আভাস তিনি আগেই পেয়ে গেছিলেন। ওনার শেষ ছবি ছিল it’s my life যেটা ২০২০ সালে রিলিজ হয়।
ইন্দরের মোট ৩ টে বিয়ে ছিল । প্রথম দুটি বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তিনি পল্লবীকে বিয়ে করেছিলেন ।এই পল্লবী শেষ জীবন পর্যন্ত ওনার ছিলেন ছিলেন। ইন্দর চলে যাওয়ার পরও তিনি ওনার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।