দিল্লি, ২২ মার্চ — কোনও মামলার বিচারে কোনওরকম পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য করা থেকে দেশের সমস্ত আদালতকে বিরত থাকার পরামর্শ দিল সুপ্রিম কোর্ট । দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি হিমা কোহলি ও বিচারপতি পিএস নরসিংহর একটি বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাত বছরের একটি ছেলেকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় অভিযুক্তের মৃত্যদণ্ড ঘোষণা হলে, সেই সাজার পুনর্বিবেচনার আবেদনের মামলায় এই মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ।
ওই ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড পুনর্বিবেচনার ওই আবেদন ইতিমধ্যেই খারিজ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তা খারিজ করে আদালতের তরফে জানানো হয়েছে, ‘বাচ্চা ছেলেটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুন করার ঘটনায় তার মা-বাবা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। মা-বাবার এই একমাত্র সন্তান হারানোর বেদনার সঙ্গে এই উদ্বেগও মিশে রয়েছে, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে, বৃদ্ধ বয়সে কে তাঁদের দেখবে, কে-ই বা তাঁদের পরিবারকে দেখবে। এটা শুধু একটা নৃশংস খুন নয়, এটা গোটা পরিস্থিতিকেই চরম সমস্যায় ফেলে দেওয়া।’
আদালতের এই মন্তব্য নিয়েই নতুন করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে থাকা সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ। ডিওয়াই চন্দ্রচূড় নিজে সেই রায়ে লিখেছেন, ‘এইরকম ভয়ংকর খুনের মামলায় আদালতের এটা মোটেই বিচার করার কথা নয়, যে খুন হওয়া শিশুটি কন্যাসন্তান নাকি পুত্রসন্তান। নিহত শিশুর লিঙ্গ যাই হোক না কেন, ঘটনাটি সমান দুর্ভাগ্যজনক। কেবল পুত্রসন্তান হওয়ার কারণে সে ভবিষ্যতে মা-বাবার দায়িত্ব নিত, এমন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় আদালতের। এই ধরনের মন্তব্য পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহক, কোনও আদালতেরই এই ধরনের কথা বলা উচিত নয়।’
আদালতের পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য করা-না-করা নিয়ে আলোচনা এই প্রথম নয়। ২০২১ সালে অপর্ণা ভাট বনাম মধ্যপ্রদেশ সরকারের একটি বিশেষ মামলায় আদালতের রায়ের পরে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকে। সে সময়ে সুপ্রিম কোর্ট এই নিয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করেছিল।
ওই মামলায় দেখা গিয়েছিল, যৌন হেনস্থার মামলায় অভিযুক্ত যেন রাখি পরিয়ে দেয় অভিযোগকারিণীকে, এমনই শর্ত দিয়ে অভিযুক্ত যুবককে জামিন দিয়েছিল মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট।
এর যুক্তি হিসেবে আদালত একাধিক পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য করেছিল, যেমন: (১) মহিলারা শারীরিক ভাবে দুর্বল হন এবং তাঁদের নিরাপত্তা প্রয়োজন। (২) মহিলারা যেহেতু নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাই পুরুষরাই পরিবারের মাথা হন এবং পারিপারিক সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এমনটাই মেয়েদের মেনে নেওয়া উচিত। (৩) ‘ভাল’ মহিলারা যৌনতার ব্যাপারে বিশ্বস্ত হন, তথা সতী হন। (৪) সব মহিলারই দায়িত্ব মাতৃত্বের ভূমিকা পালন করা এবং বাচ্চাদের সব দায়িত্ব নেওয়া। (৫) মদ, সিগারেট খাওয়া মহিলারা পুরুষদের যৌনতার বার্তা দেন। (৬) কোনও মহিলার যৌন হেনস্থার অভিযোগে যদি শারীরিক ক্ষতির তেমন চিহ্ন না মেলে, তাহলে এমনও হতে পারে, সেই মহিলার সম্মতিতেই যৌনতা হয়েছে।
এই মন্তব্যগুলির পরেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে আইনের অঙ্গনেই। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, কোনও আদালতই যেন কোনও মামলায় এই ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য না করে। ফের আরও একবার খুনের মামলার সাজা বহাল রাখতে গিয়ে এই ধরনের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট।