রাজেশ কুমার
একটা নীল আলোর মধ্যে দিয়ে অবিরাম তাকিয়ে থাকলে মানুষের মধ্যে একটা জগৎ গড়ে ওঠে। বলা যেতে পারে তার চোখের সামনে যা সব ঘটে চলে, সে ঢুকে পড়ে সেসবেরই ভেতর বিশেষত তা যদি উদ্ভট, অকল্পনীয় কিছু হয়। আর এইভাবেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে বহুদিন আগে আমি ঢুকে পড়েছিলাম জলছবির মতো আস্ত একটা দেশের ভেতর, অ্যাপিচাটপং ওয়েরাসেথাকুল-এর ছবির মাধ্যমে। পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশনের সরকারি স্ট্যাম্প ছাড়াই।
দেশ তো আসলে একটা ধারণা। ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয় তাকে, বেঁধে রাখা হয় কাঁটাতারের বেড়ায়। অনেকটা ফটোফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা ছবির মতো। তবুও পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই কখনও কখনও ঢুকে পড়া যায় অন্যের দেশের ভেতর কিম্বা নিজের ভেতর অজান্তে গড়ে তোলা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ! পেরিয়ে যাওয়া যায় পাহাড়ের দুর্গমতা, সমুদ্রের অনতিক্রম্যতা কিম্বা বিপদসংকুল মরুভূমির ধূসরতা। সেসব বিশ্বনাগরিকের দেশ। এক বিমূর্ত উর্বর ভূমি, দূর উপত্যকার গায়ে লেগে থাকা মেঘের মতো। তার ভেসে বেড়ানো আছে, বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া্র বিলাসিতা আছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উদাসীনতা নেই। সে বোঝে না ভাষাগত দূরত্ব; জাতি, ধর্মের তত্ত্ব কিম্বা আইনের বেড়াজাল, এক্সট্রাডিশন, ডিপোর্টেশনের আধুনিক জটিলতা।
আমার কাছে থাইল্যান্ড তেমনই। ‘সিমেট্রি অফ স্প্লেন্ডার’-এর দেশ। ‘আংকেল বুনমি হু ক্যান রিকল হিজ পাস্ট’ কিম্বা ‘সিন্ড্রোমস অ্যান্ড আ সেঞ্চুরি’। এখানে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তৈরি হওয়া আলোর জাফরির মতো জেগে থাকে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি সব ঘটে চলা বর্তমান। এক অজানা কারণে ছড়িয়ে পড়া মহামারী ঘুমের ভেতর আচ্ছন্ন করে রাখে একদল সৈন্যকে। হাসপাতালের বেডে পাশাপাশি শুয়ে থাকে তারা। বাইরে একটা বড় জেসিবি মেশিন মাটির স্তূপে চালিয়ে যেতে থাকে তার বেমানান খনন কার্য। সৈন্যরা কথা বলে ঘুমের মধ্যে। মেকং নদীর তীরে একই সঙ্গে বাস করে এক রক্তচোষা মা ও তার রক্তমাংসের মেয়ে। সেই মা অন্যের রূপ ধারণ করে। বেঁচে থাকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ভিসেরা, কিডনি, লিভার খেয়ে। আবার আংকেল বুনমির খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ আবির্ভূত হয় বহুদিন আগে মারা যাওয়া তার স্ত্রী। ফিরে আসে স্ত্রী মৃত্যুর পর তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে শিম্পাঞ্জির মতো বড় বড় চুল আর লাল জ্বলন্ত চোখ নিয়ে। সে ছবি তুলেছিল এক অশরীরী হনুমানের। তারপর ভুলে গেছিল তার পুরোনো পৃথিবীকে।
এসব এক অদ্ভুত জগৎ। এক জটিল স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা। লোককথা আর অলৌকিকের মিশ্রণ। সেখানে আত্মারা যাতায়াত করে, আধুনিক পোশাক পরে, অনেক বছর আগে জীবিত ছিল যারা, বসবাস করত সেই দেশে। যারা জানত হাসপাতালের নীচে কবরখানাটা ঠিক কোথায় ছিল কিম্বা হারিয়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদের কোন অংশ কোথায়। সরকার, মিলিটারি, আর্মির কথা নয়। সেসব নিতান্তই না-মুখ কিছু সাধারণ মানুষের কথা। এক যুবক গিটার বাদক আর এক যুবতী নারীর পরস্পরের প্রতি বেড়ে চলা আকর্ষণের কথা। আদ্যোপান্ত রূপকে মোড়া- প্রেম আর রাজনীতির কথা। বহুদিনের চেনা গ্রামের বাড়ির মতোই সেখানে কলার বাগান, কাঁঠালের গাছ, ছোট ছোট টিলা পাহাড়, শান্ত নদী। নদীর পারে অলস জীবন, মানুষের বসে থাকা কিম্বা ইশান অ্যাকসেন্টে কথা বলা। বিকেলের পড়ন্ত রোদে ছেলেদের ফুটবল খেলা, আধ খাওয়া বিষণ্ণ খাবারের ওপর দিয়ে সার বেঁধে পিঁপড়েদের চলে যাওয়া।
এসবই ভেসে ওঠে আকাশের ক্যানভাসে, মাঝরাত ঢলে গেলে। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টের ঠিক বাইরে, মাথার ওপর কৃত্রিম আলো। বড় বড় পাইথনের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মসৃণ ফ্লাইওভার। ফ্লুরোসেন্ট আলোয় থৈ থৈ পথরেখা চলে গেছে বহুদূর, যেন অন্ধকার সমুদ্রে সাদা ফসফরাস জেগে আছে চিত্রার্পিত ঢেউয়ের মাথায়। ফাঁকা রাস্তা, গাড়ির সংখ্যাও হাতে গোনা। যে কটা আছে তাদেরও তাড়া নেই সেভাবে। সবাই যেন চলেছে ধীর গতিতে, একই গন্তব্যে, শহর থেকে দূরে, কিসের একটা হাতছানি পেয়ে। আমার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। আর সেই সুযোগে ওয়েরাসেথাকুল-এর যত চরিত্র সব নেমে আসছে পাটায়ার দিকে ছুটে চলা এক গাড়ির বনেটে। জানালার বন্ধ রাখা কাচে, হেড লাইটের আলোয় এক কাল্পনিক প্রজেক্টরে। গৃহবধূ ও স্বেচ্ছাসেবী জেন্ দেখাশোনা করছে অচেতন সৈন্যদের। তার একটা পা ছোট, আর একটা বড়। বগলে ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে সে যেন আমারই বাড়ির উঠোনে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটা বুম ঘুরে বেড়াচ্ছে বাজারে, দোকানে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে, এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের কাছে। তারা এক নিঃসঙ্গ বালক আর তার দিদিমণির গল্প বলছে, ‘মিস্ট্রিয়াস অবজেক্ট অ্যাট নুন’। লোকমুখে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই গল্পের কাহিনি। জানতে চাইছে নিঃসঙ্গ সেই ছোট্ট ছেলেটার দিদিমণি আদৌ এগজিস্ট করে কিনা! দেখা দেয় রহস্যময় চর্মরোগে আক্রান্ত সেই যুবক, যুবতী প্রেমিকাকে নিয়ে জঙ্গলে নিভৃতে সময় কাটাতে যায় যে। সঙ্গম শেষে পাশাপাশি শুয়ে থাকে মাটির ওপর চাদর বিছিয়ে, আকাশের দিকে মুখ করে। এক অদ্ভুত সুখ খেলা করে তাদের আকাশে, বাতাসে, জলে, জঙ্গলে। চারপাশে ঝিঁঝি ডাকে। দু’জন বৌদ্ধ মঙ্ক বসে থাকে ব্যাংককের এক ডেন্টাল ক্লিনিকে। মাঝবয়সি মহিলা ড্রাইভারের মঙ্গোলয়েড চোখ ফাঁকি দিয়ে থাই ভাষায় সকলেই সুস্বাগতম জানায় আমাদের। আমরা দু’জনে তাকিয়ে থাকি দু’জনের দিকে। চোখে মুখে একরাশ রোমাঞ্চ, হয়তো বা উৎকন্ঠাও। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। অচেনা রাস্তা, গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলা অপরিচিত গান। সঙ্গে ছুটে চলা অবিশ্বাসী রাত। আমাদের মনের মধ্যে কী হয় কী হয় ভাব। শিরদাঁড়া বেয়ে নামে জমে থাকা এক ঠান্ডা অনুভূতি, বেখেয়ালে ছড়িয়ে থাকে সারা শরীরজুড়ে। ওদিকে গুগল জানান দেয় হোটেলের ঠিকানা তখনও নব্বই মিনিট দূরত্বে। আন্তর্জাতিক সময় মেনে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিই দেড় ঘন্টা। রাত তখন প্রায় আড়াইটে, ওদেশের হিসেবে। মোবাইলে ধরা হোটেলের নাম, হোয়াটস অ্যাপে সম্পূর্ণ সফরসূচী, পাঠিয়েছে বাণিজ্যিক সংস্থা যারা এদেশ ঘুরিয়ে দেখাবে আমাদের। ওদিকে চোখ ঢুলে আসছে অভ্যাসের ঘুমে। অথচ কে যেন কথা বলছে আমার ভেতর। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মতো; নিরুত্তাপ, অভ্যস্ত স্বরে, সিনেমার লং শটে ভেসে আসা উদাসীন ভয়েস ওভারের মতো। বলছে, ঘুমিও না জেগে থাকো। ঘুমের মধ্যে পথ ভুলিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে চলে যাব আমি। এ আমার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। মেয়েটাকে আইডেন্টিফাই করতে পারছি না আমি। অনুভব করতে পারছি না তার যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের কারণ। অদ্ভুত এক অস্বস্তি হচ্ছে আমার ভেতর। কন্ঠস্বর ফিরে আসছে বারবার, দূর পাহাড়ে প্রতিধ্বনির মতো। ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে স্প্যানিশ গিটারের মৃদুমন্দ ঝংকার। ছেয়ে যাচ্ছে বর্ষার মেঘের মতো, বয়ে চলা নদীর মতো। আর তা যেন গভীরে যেতে বলছে আমায়, আরও গভীরে, অনুভূতির চরমতম সীমায়।
আমার মনে পড়ে ‘সিমেট্রি অফ স্প্লেন্ডার’-এর সেই কেং নামক মেয়েটির মুখ ঘুমন্ত সৈনিকদের সঙ্গে স্বপ্নে কথা বলতে পারত যে। জানতে পারত ঘুমের মধ্যে তারা কী করছে। কমিউনিকেট করত ঘুমন্ত সেই সৈনিকদের নিকট আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। থেকে থেকেই টান হয়ে বসি আমি। সিনেমায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, কেং একজন এফ বি আই এজেন্ট। যদিও সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই কোনও। আমি চোখ রাখি গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে। লক্ষ্য করি মাঝে মাঝেই ভাগ হয়ে যাচ্ছে ফ্লাইওভার। শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে পড়ছে একটু আগে ইমিগ্রেশন নিয়ে ঢোকা দেশটার শরীরের মধ্যে। অলিতে গলিতে, প্রত্যন্ত প্রান্তরে। দূরে এক এক করে পেরিয়ে চলেছে ছোট ছোট পাহাড়ের সিল্যুয়েট যেন সিক্সটিন এম এম ফিল্মে শ্যুট করা কিম্বা এনলার্জ করা থার্টি ফাইভ এম এম এ।
আমাদের পুরো সফরজুড়ে যেন ওয়েরাসেথাকুলেরই কোনও সিনেমা। ক্যামেরার ধীর স্থির নড়াচড়া। অনেকটা সময় নিয়ে অবজেক্টের ওপর ফোকাস করা। গোল্ডেন বুদ্ধা কিম্বা মার্বেল টেম্পল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন রূপের বুদ্ধমূর্তি। একটানা লম্বা শট। মাঝে মধ্যেই ব্ল্যাক হয়ে যাওয়া, টাইম স্পেস। তারপর আবার শুরু হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। পর্দায় হঠাৎ কোনও চরিত্রের আগমন আবার হঠাৎ-ই তার ফেড আউট হয়ে যাওয়া। হারিয়ে যাওয়া, হয়তো বা চিরকালের জন্য।
আমাদের চোখের সামনে শান্ত দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগরেরই একটা অংশ। অর্ধবৃত্তের মতো ঢুকে এসেছে পাটায়া সিটির পেটের ভেতর। দূরে, অনেকটা নীচে সী গ্রিন রঙ আর মাথার ওপর উপুড় করা হাতের মতো ছেয়ে থাকা আকাশ, কোথায় যেন চলে গেছে দুজনে। এলোপ করেছে কোনও নির্জন প্রান্তরে আর সমুদ্রের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গগনচুম্বীগুলো ইয়ং অ্যান্ড হ্যান্ডসাম ভাড়াটে খুনির মতো দূরবিন চোখে অপেক্ষা করছে তাদেরই ফিরে আসার জন্য। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গগণচুম্বী নকশার টানাপোড়েন যা উষ্ণতা ছড়ায় শেষ হয়ে আসা দিনের আলোয় আর দাঁড় করিয়ে রাখে স্থানুবৎ। তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দিকে।
আমাদের ড্রাইভার জে শিখিয়েছিল ‘খাপখুন’ মানে ধন্যবাদ। মেয়েদের বলতে হয় খাপখুন খা আর ছেলেদের খাপখুন খাপ। আমাদের জন্যে লজেন্স এনেছিল সে। থাই সংস্কৃতিতে কোনও কিছু দেওয়াকে আসলে বিনয় প্রকাশ হিসেবেই ধরা হয়। ও দেশের মানুষ ইংরাজি বোঝে না বিশেষ। ট্রান্সলেটরে ফেলে দেখাতে হয়। ব্যাংককে আমাদের গাইড কেন্ বলেছিল, ওদের সতেরোটা প্রভিন্স। সবকটা প্রভিন্সেরই অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ থাই। তাই ইংরাজি ভাষাটারই দরকার পড়ে না সেভাবে যদিও স্কুল লেভেলে শেখানো হয় তা।
রাস্তাঘাটে একটা বিষয় চোখে পড়ে, ইংরাজি বললে থাই মানুষগুলো মিটিমিটি হাসে। তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তখন মনে হয় সারা দেশ জুড়েই লাফিং বুদ্ধা। হোটেলে, সেভেন ইলেভেন শপে, স্ট্রিট ফুডের স্টলে, রাস্তার ক্রশিংয়ে। বৃষ্টিতে আটকে পড়া শপিং মলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের খোঁজ দিতে অযাচিত এগিয়ে আসা সেই থাই তরুণী কিম্বা রাতেরবেলা রাইড হেইলিং অ্যাপে ক্যাব বুক করে সহায়তা করা হোটেলের সেই তরুণ রিসেপশনিস্ট অনুভব করায় সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বুদ্ধের বাণী আর তার বৃহৎ প্রতিকৃতির ছায়া। তাদের আতিথেয়তা, সাহায্যপরায়ণতা, সময়ানুবর্তিতা ঢুকে পড়ে আমাদের ভেতর। রক্ত, মাংস, চেতনা, স্মৃতিকে করে তোলে আচ্ছন্ন।
জে’র অবশ্য ইংরাজির সমস্যা ছিল না। মোটের ওপর কাজ চালিয়ে নিতে পারত সে। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যই আমাদের সঙ্গী হয়েছিল জে। তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাঁচ তোলা ক্যাবে আমরা পেয়েছিলাম এক আশ্চর্য সুগন্ধি যা আমাদের মনে করিয়েছিল মন্দিরের কোনও পবিত্র গন্ধ। এক নিরিবিলি দুপুরে সে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল পাটায়া শহরটা। তুলে দিয়েছিল বেশ কিছু সুন্দর ছবি। তারপর উষ্ণমণ্ডলের অসুস্থতা ধরিয়ে মিশে গেছিল নীচে, পাটায়া শহরের ভিড়ে। কিম্বা ফিরে এসেছিল মন্ত্রীর রূপ ধরে, বৌদ্ধ শাস্ত্রানুসারে রি-ইনকারনেশনের ধারণা মেনে।
মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে ছিল পুরো দুটো দিন। ব্যাংকক মেরিন পার্ক, সাফারি ওয়ার্ল্ড দেখিয়ে আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল হোটেলে। সে ইংরাজি বিন্দু বিসর্গ বুঝত না। অথচ সবথেকে বেশি কথা বলত আমাদের সঙ্গে। এত কথা যে কোথা থেকে আসত বুঝে পেতাম না আমরা। সে আমাদের শিখিয়েছিল, করুণা রুদ্রাখা। মানে দয়া করে দাম কমান বলতে। হুংনাম, ওয়াশরুম বোঝাতে। মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতাম আমরা। অদ্ভুত এক সারল্য ছিল ওর মধ্যে। দেখে মনে হত পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ সে। মন্ত্রী যখন গাড়ি চালাত একটা চোঙাকৃতি কনটেইনার ভর্তি কুঁচো বরফ রাখত সঙ্গে। সেই বরফ একটু একটু গলত আর মন্ত্রী স্ট্র দিয়ে ছোট ছোট শিপ নিত। এই প্রক্রিয়া তার চলত সারাদিন ধরে। এছাড়া থাকত লাঞ্চবক্স। তাতে দুপুরের খাবার। মাঝে মধ্যে তার ফোন আসত বাড়ি থেকে। সব মিলিয়ে গাড়ির ভেতর ছোট্ট এক পরিপাটি সংসারের ছায়া, যা ছিল ‘ট্রপিক্যাল ম্যালাডি’র সেই উত্যক্তকারী আত্মার ছায়া থেকে অনেক দূর। মন্ত্রীর একটা ইলেক্ট্রিক সিগারও ছিল। গাড়ি দাঁড় করালে মাঝে মধ্যেই টান দিত তাতে। ইলেক্ট্রিক সিগারটা ওদেশে বেশ চলে। রাস্তায় আধপোড়া সিগারেটের টুকরো প্রায় দেখাই যায় না। কোনও কোনও দোকানের সামনে ফুটপাতের ধারে পেতে রাখা চেয়ার টেবিলে থাকে অ্যাশট্রে। সেদেশের মানুষ বিরত থাকে পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়া, রাস্তায় থুথু ফেলা এমনকি গাড়ির সিটে বসে বমি করা থেকেও।
সী গ্রিন কালারটা ছিল যেন কোনও রোমাঞ্চের প্রতীক। স্পীড বোটে যখন ছুটে চলেছিলাম সমুদ্রের ভেতর কোহ্ লার্ন আইল্যান্ডের দিকে মনে হচ্ছিল দক্ষিণ চীন সাগরের একদা রোমহর্ষক সেই জলদস্যুদের গোপন কোনও ডেরার উদ্দেশ্যে চলেছি আমরা যেখানে সঞ্চিত আছে হাজার বছরের লুন্ঠিত সম্পদ অথবা পৌঁছে যাব সেই রহস্যময় জঙ্গল ঘেরা জায়গায় যেখানে জলের ওপর ছায়া পড়েছিল নাম না জানা কোনও এক রাজকুমারীর। যে ছায়া ছিল তার নিজের থেকেও সুন্দর। সেই ছায়ার মতো সুন্দর হতে চেয়ে এক মাগুর মাছের আহ্বানে জলাশয়ে নেমেছিল সে। একটা একটা করে উৎসর্গ করেছিল তার চোখ ধাঁধানো গহনা, খুলে ফেলেছিল জলের ভেতর। নিজেকে করেছিল আবরণ ও আভরণ মুক্ত। মিলিত হয়েছিল সেই অলৌকিক মাগুর মাছের সঙ্গে।
কোহ্ লার্ন আইল্যান্ডে আমাদের সঙ্গে ছিল স্বপ্নভঙ্গের মীনাকুমারী। হিন্দি সিনেমার সেই লাস্যময়ী নায়িকা নয়, নাম শুনে যাকে আমরা আশা করেছিলাম ও পুলকিত হয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। সে ছিল আপাদমস্তক পুরুষালি চেহারার এক ট্রান্সজেন্ডার। মীনাকুমারী আমাদের জন্য আন্ডার ওয়াটার সী ওয়াকিং এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সাহস যুগিয়েছিল ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে। দায়িত্ব নিয়েছিল সঙ্গের ব্যাগ বোঁচকা সুরক্ষিত রাখার। সমুদ্রের নীচের কোরালের মতোই আমরা দেখেছিলাম তার একটা সুন্দর ব্যবহার আছে। পুরুষতান্ত্রিক ভালো লাগার চাহিদা ছাড়িয়ে যা জিতে নেয় আমাদের মন।
তবে রক্ত মাংসের শরীর ছাড়িয়ে বহু চর্চিত ওয়াকিং স্ট্রিটে হাজার হাজার বিকিনি সুন্দরীর ভিড় পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে যেখানে শেষ হচ্ছে রাস্তা সেখানে এক নির্জন প্রন্তরে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ‘সিমেট্রি অফ স্প্লেন্ডার’-এর সেই দুই সুন্দরী, যুবতী নারীকে যারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল বহু যুগ ধরে বেঁচে থাকা রাজকুমারী হিসাবে। কথিত আছে তারা জীবিতের সঙ্গে কথা বলে, টেনে নেয় তাদের জীবনীশক্তি। আর এইভাবেই নিজেরা থেকে যায় চির যুবতী হয়ে। মারা যায় সেই সব জীবিতেরা। ওদের সামনেটুকু আমরা পেরিয়ে গেছিলাম চরম উদাসীনতায় ঠিক যেভাবে জীবন এগিয়ে চলে মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে। অবহেলায়, অবলীলায়।
নৌনুজ গ্রাম ছিল আর এক বিস্ময়ের জায়গা। কৃত্রিম জঙ্গল, ঝরনা, বয়ে যাওয়া জলের ধারা থেকে ওঠা সালফারের রহস্যময় ধোঁয়া, অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসোর আর তার মস্ত ডিম। সব মিলিয়ে এক আদিম পৃথিবী যে পৃথিবীতে হয়তো হারিয়ে গেছিল আংকেল বুনমির সেই অতিকায় ছেলে। অশরীরী হনুমানের ছবি তুলে যে শুরু করেছিল এক অলৌকিক জীবন। তার চোখ দুটো হয়ে উঠেছিল করমচার মতো লাল, গায়ে শিম্পাঞ্জির মতো লোম। তবে তার সেই জগতের মতো নৌনুজ গ্রামে ছিল না কোনও রহস্যময় জীব কিংবা ‘ট্রপিক্যাল ম্যালাডি’র সেই ভ্রাম্যমান আত্মা জঙ্গলে যা ঘুরে বেড়াত কখনও ষাঁড়ের রূপ ধরে কখনও বা বাঘের। উত্যক্ত করত অস্ত্রধারী প্রহরীদের। গ্রহণ করত তাদের বুদ্ধি, বৃত্তি, মেধা। বরং সেখানে ছিল এক নিখাদ জঙ্গল অভিযানের আনন্দ। যে আনন্দে মানুষ যায় বনভোজনে, সপ্তাহ শেষে। ছবি তোলে, খাবার খায়, চারপাশ খোলা ব্যাটারির গাড়ি চেপে অবাক করা সব ক্যাকটাস দেখে বেড়ায়।
দিনের আলো ফুরোলে চাও ফ্রায়া নদীতে আসে এক অলৌকিক জলযান। বৃহৎ ক্রুজের মতো সে আমাদের নিয়ে যায় মায়ালোকে, এক আশ্চর্য ভ্রমণে। দু’পাশের সব জাদুকরী বিল্ডিং তাকিয়ে থাকে বিষ্মিত চোখে, মায়াবী আলো মেখে। তাকিয়ে থাকে দেশ বিদেশের পর্যটকদের দিকে। তাদের সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক, খাবার-দাবারের দিকে। এ যেন এক পারস্পরিক সম্ভ্রম, বহুদিন আগের সই হওয়া কোনও চুক্তিপত্র। রাজকীয় ভঙ্গিমায় যাত্রীরা ডেকের ওপর ছবি তোলে কেতাদুরস্ত পোশাক পরে, প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরে কিম্বা ঘনিষ্টভাবে চুম্বন করে। রাতের খোলা আকাশের নীচে রূপের ঝলক চকচক করে ওঠে ধারালো তরবারির মতো। উদ্দাম সঙ্গীতের স্বর আছড়ে পড়ে দু’পাড়ে। আলোড়ন তোলে চাও ফ্রায়ার জলে। আবার সামান্য দূরেই বেমানান এক লঞ্চ নিঃশব্দে পেরিয়ে যায় সামান্য কিছু রঙহীন স্থানীয় যাত্রী নিয়ে। যারা হয়তো ঘরে ফেরে সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে, ক্লান্ত শরীরে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করে। অলৌকিক সেই জলযান থেকে তাদের মূক ও বধির লাগে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশে মালিক ও শ্রমিকশ্রেণী থাকে। চাও ফ্রায়ার জলে একই সঙ্গে ভাসে প্রাচুর্য আর স্বল্পতা। বেমানান সেই লঞ্চ বারেবারে ফিরে আসে আমাদের চেতনায়। মনকে করে তোলে বিষণ্ণ, ভারাক্রান্ত।
ইন্ডি আসে আলকাজার শো শুরুর ঠিক আগের মুহূর্তে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সে-ই অপারেট করছিল আমাদের পুরো ট্রিপটা। বার বার বলছিল সময় মেনে চলার কথা। যদিও পুরো ট্রিপে কোথাও লেট করিনি আমরা। বুঝতে পারছিলাম পাংচুয়ালিটির আলাদা মানে আছে ওদের কাছে।
অর্গানাইজাররা শুরু করেছিল সন্ধে ঠিক সাতটায়। আলকাজার, পৃথিবী বিখ্যাত এক ক্যাবারে শো। অত্যাধুনিক আর জাঁকজমকপূর্ণ তার পরিবেশন। স্টেজ, লাইট, ড্যান্সার, কস্টিউম সমস্ত কিছুই চোখ ধাঁধানো। নানান দেশের ট্যুরিস্ট আসে এই শো দেখতে। অডিটরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। তুমুল উন্মাদনা উপস্থিত সকলের মধ্যে। প্রথমে ওয়েস্টার্ন, তারপর ট্র্যাডিশনাল। ভারতীয়দের জন্য বেজে উঠল এক টুকরো বলিউড। ঝলক দিখলাঁ যা…। তারপর চাইনিজ, চীন দেশের জন্য।
আর ঠিক তখনই মন খারাপ হয়ে গেল আমার। মনে হল পৃথিবীটা দিন দিন বিরাট রাস্তা হয়ে উঠছে একটা। গিলে খাচ্ছে সব স্থানিকতা, নিজস্বতা। থেকে যাচ্ছে শুধু এক পপুলার কালচার। আলকাজারের সেই উদ্দামতায় ছিল না কোনও বিনম্র সঙ্গীত, ধীরে ধীরে তার গভীরে চলে যাওয়া, অলৌকিকতা, লোকগাথা।
নিজেকে মনে হচ্ছিল অনুপ্রবেশকারী। ভুল করে অন্যের দেশে ঢুকে পড়া মানুষ। এয়ারপোর্টের পথে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আমার শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রঙমাখা আদিবাসী নৃত্যের কথা। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজতেই ভেসে উঠল কমলালেবুর মতো দু’দিক চাপা এক টিনসেল টাউন। আর তার বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ। প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকগাথা। মনে হল ক্রমশ এক ভীষণ অবাস্তব পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা।