সুড়ঙ্গ আঁধার কাটতে এখনও অপেক্ষা ১২-১৫ ঘন্টার

উত্তরকাশি সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতে অধীর অপেক্ষায় ৪১ প্রাণ 

উত্তরকাশী, ২৪ নভেম্বর –  চন্দ্রযান-৩-এর চাঁদের মাটিতে পা রাখা থেকেও এই অপেক্ষা যেন আরও তীব্র। কারণ তরতাজা ৪১টি প্রাণ শুক্রবার  ১৩ দিন পরও ধ্বসে পড়া সুড়ঙ্গে আটকে থেকে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল যে ভারত পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্ন সত্যি করতে পারে,  সফল অভিযান করে বিশ্বরেকর্ড গড়তে পারে, সূর্যের অত কাছে যাওয়ার কীর্তি গড়তে পারে সে কিনা ১৩ দিন ধরে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছে । যদিও গত ১৩ দিন ধরে উত্তরাখন্ড সরকার যুদ্ধকালীন লড়াই করে চলেছে। বিদেশ থেকে আনানো হয়েছে সুড়ঙ্গ কাটার বিশেষ যন্ত্রও। কিন্তু বিধি বাম। বৃহস্পতিবার সকালে তারপর শুক্রবার সকালের মধ্যেই উত্তরকাশীর ভেঙে পড়া সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছিল বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, কিন্তু বাদ সাধল সুড়ঙ্গের ধসে পড়া অংশের ধাতব খণ্ডাংশ। ফলে বৃহস্পতিবার রাতভর চেষ্টাতেও সুড়ঙ্গ-মুক্তি ঘটল না ৪১ জন শ্রমিকের।

তবে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা সেই ৪১ জন শ্রমিককে কুর্নিশ না জানিয়ে থাকা অসম্ভব। এই প্রতিকূলতায় জীবন বাতি যেখানে যেকোন মুহূর্তে নিভতে পারে সেখানে যেভাবে তারা বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। আর সেই কারণেই বোধয় তাদের উদ্ধারের কাজে স্বয়ং হাজির থাকতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি। আর তাই সুড়ঙ্গের কাছেই তৈরি করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অস্থায়ী দফতর। উদ্ধারকাজে নজর রাখতে সেখানেই সারা রাত থাকবেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী।

বৃহস্পতিবার কাজ থমকে যাওয়ার পর জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্য সইদ আটা হাসনাইনের আশ্বাস, ‘আরও বেশ কিছু ঘণ্টা লাগবে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত বা শুক্রবার সকালের মধ্যে আমাদের অপারেশন সফল হবে বলেই মনে হয়।’ 

অন্যদিকে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রাক্তন উপদেষ্টা ভাস্কর খুলবে জানান, সুড়ঙ্গের ভিতরে আটকে থাকা ৪১ শ্রমিকের কাছে পৌঁছতে আরও ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে।

উল্লেখ্য,  গত ১২ নভেম্বর উত্তরকাশী জেলার ব্রহ্মতাল-যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের উপর সিল্কিয়ারা এবং ডন্ডালহগাঁওের মধ্যে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের একাংশ ধসে পড়ে। সুড়ঙ্গটি সাড়ে আট মিটার উঁচু এবং প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ। ভাঙা সুড়ঙ্গের ভিতরেই প্রায় ৬০০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে পড়েছিলেন ৪১ শ্রমিক। আটকে ৪১ থাকা জন শ্রমিক, যার মধ্যে রয়েছেন বাংলার তিন – হুগলির জয়দেব প্রামাণিক, সৌভিক পাখিরা, কোচবিহারের মানিক তালুকদার। একটি চার ইঞ্চির পাইপ দিয়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছচ্ছে অক্সিজেন। ছ’ইঞ্চির পাইপ দিয়ে পাঠানো হচ্ছে রুটি, সব্জি, খিচুড়ি, খাওয়ার জল, ফল, ওষুধের পাশাপাশি টি-শার্ট, অন্তর্বাস, টুথপেস্ট, সাবানও।

বুধবার রাত থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছে ২০টি অ্যাম্বুল্যান্স। সুড়ঙ্গ থেকে বার করার পর প্রয়োজন হলে শ্রমিকদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। ঘটনাস্থলেও অস্থায়ী স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেখানে তৈরি আছে ৪১টি ‘বেড’। যে কোনও রকম জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত উদ্ধারকারীরা।

বুধবার রাতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়তে খুঁড়তে আচমকা সামনে চলে আসে লোহার রড। খননযন্ত্র দিয়ে তা সরানো যায়নি। ফলে উদ্ধারকাজ বাধা পায়। রড কেটে রাস্তা ফাঁকা করতে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে বলে জানানো হয়। রডটি কাটতেই বেগ পেতে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। এ ছাড়াও, এক বার কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। টানা খুঁড়তে খুঁড়তে যন্ত্র অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। ফলে তা ঠান্ডা করার জন্য আরও কিছুটা সময় লাগে। বৃহস্পতিবার সকালে সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছিল, অবশেষে লোহার রডটি কেটে সরানো গিয়েছে। আটকে পড়া শ্রমিকদের সঙ্গে উদ্ধারকারীদের দূরত্ব আর মাত্র ছ’মিটার। ফলে এ বার দ্রুত কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী সকলে। কিন্তু তার পরেই ফের প্রযুক্তিগত সমস্যা।


প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রাক্তন উপদেষ্টা ভাস্কর আগে জানিয়েছিলেন, শুক্রবারই বের করে আনা যাবে ১৩ দিন ধরে আটকে পড়া শ্রমিকদের। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। এখন প্রশ্ন যদি কিন্তু এতদিন বদ্ধ জায়গায় আটকে থাকা শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কথা ভেবেই এনডিআরএফের এক বা একাধিক কর্মী পাইপ পরিষ্কার করতে করতে ভিতরে যাবেন, যাতে স্ট্রেচারের মুভমেন্ট কোনও বাধা না পায়। পাইপের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তাঁরাই স্ট্রেচারে তুলে দড়ির মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদে বাইরে আনার কাজটি করবেন। কারওয়ালের দাবি, ‘৮০০ মিলিমিটার পরিধির পাইপে বিস্তৃতি থাকে মোটামুটি ৩২ ইঞ্চি, যা একজন মানুষকে টেনে বের করে আনার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের টিম এই কাজের মহড়াও দিয়েছে।’

গতকাল উদ্ধারকাজ বন্ধ হওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রাক্তন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “যে প্ল্যাটফর্মের উপর মূল মেশিন রয়েছে, সেটার ভিত কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মেশিন চালানোর জন্য ভিত মজবুত হওয়া প্রয়োজন। সেই কারণে প্ল্যাটফর্ম পাল্টাতে হয়েছে। তাই কিছুটা সময় লেগেছে। এই প্ল্যাটফর্ম বদল করার জন্য অগার মেশিন, যে মেশিনটি দিয়ে খনন করা হচ্ছে, তা বাইরে বের করে আনতে হয়েছে। তারপর ভিতরে লোক পাঠাতে হয়েছে।”

যাই হোক এখন অপেক্ষা শুধু সেই সময়ের  যখন ওই সুড়ঙ্গ থেকে একে-একে হাঁসিমুখে বাইরে বেরিয়ে আসবে ৪১ শ্রমিকই।