‘৩ বছরে শুরু। শেষ আমার শেষেও নয়।’ খুব সহজ-সরল ভাষায় গানকে এভাবেই বোঝালেন সহজ মা। বাংলার বিখ্যাত বাউল শিল্পী। যদিও সহজ মা-এর পরিচয় তাঁর গানে। আলাদা করে তাঁকে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার হয় না। সহজ মা অবশ্য গুরুর দেওয়া নাম। তার আগের নাম শর্মিষ্ঠা বসু। কিন্তু সহজ হয়ে ওঠার পর আজ নিজেও ভুলে গেছেন মা-বাবার দেওয়া সেই নাম।
‘যেমন কণ্ঠ, তেমনি গায়কী। অনবদ্য, উৎকৃষ্ট, অসাধারণ।’ যেখানেই গাইতে ওঠেন শেষে তাঁর পাওনা এটাই। ক্লাসিকাল আর ফোকের মিলনে যে অসাধারণ সুর তা কেবল সহজ বা সহজিয়া মায়ের দ্বারাই সম্ভব।
গানের শুরুর প্রশ্নে সহজ মা জানান, ‘৩ বছর বয়েসে গানের জগতে পদার্পন তাও শাস্ত্রীয় সংগীতে। গানটা রক্তের সম্পর্কে পাওয়া। বাবার ঘরানা ছিল সহজিয়া আর মায়ের তরফে বাউল। যদিও সেভাবে বাউলের চর্চা বিয়ের আগে হয়নি। ১৯৯৪ তে বিয়ের পর প্রথম বাউলের সংস্পর্শ। উৎপালবাবুই একদিন বললেন তার সঙ্গে বাউল গাইতে আর আমার বাউলের শুরু। তারপর লোকগীতি, সুফী, ঝুমুর, সবকিছুই গাওয়া শুরু। তবে কি জানেন, আমার গানের পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে বলতে হয় একেবারে রাজ ঘরানা থেকে ফকির-দরবেশ-বাউল ঘরানায় প্রবেশ। সেখান থেকেই শিখেছি নিজেকে নিয়ে কতদিন আর ভালো থাকা যায়? তবে অন্যের মুখে হাঁসি ফোটাতে পারলেই জীবনের সুখ।’
এই যা! দেখেছেন, উৎপালবাবুকে না চিনিয়েই তার নাম বললে আপনি ভাববেন ইনি আবার কে ? উৎপালবাবু হলেন সহজ মায়ের গানের উৎস। সহজ মায়ের স্বামী উৎপল ফকির। যাক এবার আসা যাক সহজ মায়ের কথায়। যা বলছিলাম, বিয়ের পর সহজ মায়ের বাউলের সঙ্গ সেখানেই শর্মিষ্ঠা থেকে ‘সহজ মা’ নামের দীক্ষা। তারপর ১৯৯৫ তে সাত মাসের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গানের ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।
গানে প্রতিষ্ঠিত না হলে কি স্বপ্ন ? প্রশ্ন করার পর সহজ মা যা উত্তর দিলেন তারপর মনে হল প্রশ্নটাই ভুল করে ফেললাম। সহজ মা বললেন, আসলে ছোট থেকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুধু গানই দেখেছি। গানে নিজেকে মিশিয়ে ফেলার পর গান ছাড়া আর কিছু করার বা হওয়ার ইচ্ছে বা স্বপ্নের কথা কোনো দিনও মনেই হয়নি। খুব ছোট বেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম কবে গোটা বিশ্ব জুড়ে ঘুরে সবাইকে গান শোনাতে পারব। তবে কি জানান, এখন মনে হয় এই তো সবে শুরু। এখনো প্রচুর মানুষকে গান শোনানো বাকি। মানুষের মনকে সুখ দেওয়া বাকি।
বাউল নাকি সহজিয়া কোন ধারায় বিশ্বাসী প্রসঙ্গে মায়ের জবাব, ‘বাউলের থেকে ভক্তিভাব পেয়েছি। বাউল মানুষকে ভক্তি করতে, বিশ্বাস করতে শেখায় আর সহজিয়া ধারা মূর্তিতে বিশ্বাসী। সহজ হতে শেখায়-মানুষকে বুঝতে শেখায়।’
সব থেকে প্রিয় গান জিজ্ঞেস করতেই সহজ মা যেন হোঁচট খেলেন। তারপর খুব সহজ সরল জবাব দিলেন, ‘জানো এখনও আমি আমার সব থেকে প্রিয় গান খুঁজে পায়নি। তবে ‘খাঁচার মাঝে অচিন পাখি’ লালন ফকিরের এই গানটি আমার শুনতে ভালো লাগে।
প্রতি বছর ১০০টিরও বেশি গান গাওয়া হয় সহজ মায়ের। শুধু ভারত নয় বাংলাদেশেও মায়ের ভক্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়। গোটা বছরই দেশ-বিদেশ ঘুরে গান গাওয়া। মায়ের গানের মধ্যে যেমন আছে ‘নারী বড় পরম ধন, ক্ষেপার মাথায় গঙ্গা বয়ে যায়, বাংলা মায়ের বোল’ শোনেনি এমন বাঙালির সংখ্যা কম।
তবে শুধু স্টেজেই সীমাবদ্ধ নয় তাঁর গান। এরই মধ্যে বেশ চলচ্চিত্রেও গান করে খ্যাতি অর্জন করেছেন সহজ মা। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যের ফোর্স সিনেমায় সহজ মায়ের গাওয়া গানটি শোনার পর এককথায় অভূতপূর্ব না বলে থাকা যায় না। অন্যদিকে বিক্রম ঘোষ, উৎপল ফকিরের কম্পোজিশানে ‘আল্লাহ মেহেরবান খুদা মেহেরবান’ গানটি শুনলে আপনি মন্ত্রমুগধ হতে বাধ্য। ‘ এছাড়া ওনার গাওয়া ‘সহজ না হলে মানুষ, দিল কি দয়া, কে গো তুমি বারে-বারে, নদীকে বলতে গেছি আমার কথা, এ তোমার আজব কুদরতি’ গানগুলি শুলেই মনের ভেতরের পাখিটা যেন বলে ওঠে।
তবে গান ছাড়াও সহজ মায়ের আরেকটা পরিচয় আছে। যদিও সেই পরিচয়টা মা লোক চক্ষুর আড়ালেই রাখতে চান। গানের সেবার পাশাপাশি তিনি নরের সেবাতেও বিশ্বাসী। মানুষের জন্য কিছু করতে চান। তাঁর মানুষের প্রতি ভক্তিভাব ধরা পড়ে মানুষের সাহায্যে সদা তৈরী থাকার অভ্যাসেই। সহজ মা বলেন, ‘ঈশ্বর আমাদের চারটে দিলে তার একটা অন্য কারুর সাহায্যে দিয়ে দিতে বলেন। তবেই সেই পাওয়ায় আনন্দ-সুখ।’
জীবনে আর কি করতে চান প্রশ্নে সহজ মায়ের উত্তর, ‘যারা ভালো আছে তাদের পাশে না থেকে যারা ভালো নেই, যাদের সাহায্যের প্রয়োজন তাদের পাশে থাকতে চাই। তবে সেটা ঢাক-ঢোল না পিটিয়ে।’