ইম্ফল, ১৭ আগস্ট – মণিপুরে কয়েক মাস ধরে ঘটে চলা হিংসার ঘটনাবলির তদন্তের জন্য নজিরবিহীন টিম গড়ল সিবিআই। ২৯ জন মহিলা আধিকারিক-সহ মোট ৫৩ জন অফিসারকে নিয়োগ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সিবিআই সূত্রে জানা যায়। মনে করা হচ্ছে এই প্রথম কোনও তদন্তকারী দলে এত সংখ্যক মহিলা অফিসার একসঙ্গে নিয়োগ করল সিবিআই। এই দলে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসাবে রয়েছেন ডিআইজি স্তরের তিন জন মহিলা অফিসার। তাঁরা হলেন – লাভলি কাটিয়ার, নির্মলা দেবী এবং মোহিত গুপ্ত। পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করবেন সিবিআইয়ের জয়েন্ট ডিরেক্টর ঘনশ্যাম উপাধ্যায়। উল্লেখ্য, এই দলে রয়েছেন দু’জন অতিরিক্ত এসপি এবং ৬ জন ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার। এরাও সবাই মহিলা। এছাড়াও দলে রয়েছেন ১০ জন ইন্সপেক্টর। সিবিআইয়ের ইতিহাসে কখনও কোনও ঘটনার তদন্তে এত বিপুল সংখ্যক অফিসার নিয়োগ করা হয়নি বলে সূত্রের খবর।
গত ৩ মে থেকে জাতিগত হিংসার সাক্ষী মণিপুর। মাঝে পরিস্থিতি কিছুটা স্তিমিত হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এখনও পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষকে উদ্ধার করে বিভিন্ন রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চূড়াচাঁদপুর, মোরে, কাকচিং এবং কাংপোকপি জেলা থেকে বহু মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে হিংসায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অভিযোগ উঠেছে কুকি ‘জঙ্গিরা’ অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে ঘুরছে। এই আবহে কুকি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মাঝে গত জুলাই মাসে এক ভয়াবহ ভিডিও ভাইরাল হয়। দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানো হয়। অভিযোগ, তাঁদের গণধর্ষণ করা হয়েছিল। সেই ঘটনা ঘটে গত ৪ মে। ঘটনার ৭৭ দিন পর এই মামলায় প্রথম গ্রেফতার হয়। সেই একই দিনে, অর্থাৎ, ৪ মে মণিপুরের রাজধানীতে দুই যুবতীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। সেই মামলায় প্রায় ৮০ দিন পরে গিয়ে গ্রেফতার করা হয় কয়েকজন অভিযুক্তকে। এরপরই মণিপুর নিয়ে নড়েচড়ে বসে কেন্দ্র। এমনকী সুপ্রিম কোর্টও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করে। মণিপুরের হিংসার জেরে সে রাজ্যের সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে । তবে সেই পথে না হেঁটে হিংসার তদন্তে সিবিআই-কে নিয়োজিত করে কেন্দ্রীয় সরকার।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই মণিপুরে মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার মামলাগুলির তদন্তে সিবিআইয়ের এই ‘তৎপরতা’ বলে মনে করা হচ্ছে। গণধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে গত ২০ জুলাই কড়া প্রতিক্রিয়া দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর পরে গত ৮ অগস্ট মণিপুর হিংসার তদন্ত এবং হিংসার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে নজরদারির জন্য হাই কোর্টের তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গড়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, মণিপুরে হিংসার ঘটনার তদন্তে যুক্ত ৪২টি বিশেষ তদন্তকারী দলের উপর নজরদারি করবেন ভিন্রাজ্যের ডিআইজি পদমর্যাদার পুলিশ আধিকারিকেরা। এক জন ডিআইজি ছ’টি সিটের উপর নজরদারি করবেন।
প্রসঙ্গত, ইম্ফল উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনজাতি। তাদের দাবি যে তাদের তফসিলি উপজাতির তকমা দিতে হবে। তাদের এই দাবির বিরোধিতা করেছে স্থানীয় কুকি-জো আদিবাসীরা। এই আবহে গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল। সেই মিছিল ঘিরেই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে চূড়াচাঁদপুর জেলায়। এই জেলা থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জেলাতেও। সেই হিংসায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ।
মণিপুরে হিংসার ঘটনায় ছ’হাজারের বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে পুলিশের কাছে। আরও বহু এমন অভিযোগ আছে, যা মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এই সব অভিযোগের তদন্তপ্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই বিশাল এবং ব্যাপক। সচরাচর এই বিরাট তদন্তপ্রক্রিয়ায় স্থানীয় আধিকারিকদের বড় ভূমিকায় দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সিবিআই স্থানীয়দের উপেক্ষা করেই তদন্ত চালাতে চায় যাতে পক্ষপাতিত্বের কোনও অভিযোগ না ওঠে। ৫৩ জনকে নিয়ে যে তদন্তকারী দল তৈরি হয়েছে, সেখানে মণিপুরের কোনও আধিকারিক নেই।