আধুনিকতা যতই শাখাবিস্তার করুক না কেন এই শহরে, তবু তার শিকড়ে রয়ে গিয়েছে অতিতের ঐতিহ্য। তা-ই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়, জানান দেয় সেই শিকড় মাটিকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলেই সভ্যতার শাখাবিস্তার সম্ভব হয়েছে।
এই গৌরচন্দ্রিকাটুকুর প্রয়োজন হল, এই শহরের শিবরাত্রি ব্রতের উদযাপন উপলক্ষে। এই শহরের কালীমন্দিরের মহাত্ম্য নিয়ে যতটা প্রচারের আলোয় রয়েছে, শিবমন্দিরগুলি বোধহয় ততটাই অন্ধকারে। ক’জন জানে এই শহরের মহেশ্বরম শিবমন্দিরের কথা!
প্রায় দুই দশক আগে ২০০১ সালে এই মহেশ্বরম শিবমন্দিরটি কলকাতা পুরসভার ‘ঐতিহ্যবাহী ভবন’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর সংযোগস্থলে ভারতসভা হলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি দক্ষিণদিকে চলে গিয়েছে, তার শেষ প্রান্তে বাঁদিকে কেন্ডারডাউন লেনে এই ‘মহেশ্বরম শিবমন্দির’ দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিবমন্দিরের তিনটি অংশ। পাশাপাশি দু’টি পঞ্চরত্ন মন্দির এবং একটি নবরত্ন মন্দির।
মহেশ্বরম শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৮৫ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ত্রিলোকরাম পাকড়াশি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের দেওয়ান। মন্দির প্রতিষ্ঠার এগারো বছর পর তাঁর জীবনাবসনা হয়। ত্রিলোকরাম অপুত্রক ছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পরে কন্যা সর্বমঙ্গলা দেবী ও জামাতা রঘুনাথ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরির রক্ষণবেক্ষণ ও সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন আজ পর্যন্ত। ১৯৪০ এবং ১৯৭৫ সালে মন্দিরটির দু’বার সংস্কার করা হয়েছে।
আজ শিবরাত্রি উপলক্ষে মন্দিরটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জলস্নাত হচ্ছেন বিগ্রহ। মূলত বাড়ির মহিলারাই আজকের দিনে এই মন্দিরের উপাসক। হিন্দুদের যে সব পুজোপার্বণে পুরোহিতের তেমন কোনও মুখ্য ভুমিকা থাকে না, সেগুলি অনার্য যুগ থেকে পালিত হয়ে আসছে। শিবরাত্রিকে আদিম যুগের অনার্য উৎসব বলা যায়। মূলত মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এই শিবরাত্রি তিথি পড়ে। তবে কখনও কখনও তা ফাল্গুন মাসেও হয়।
কলকাতায় বিশেষ করে উত্তর কলকাতায় একসময় খুব ঘটা করে শিবরাত্রি উৎসব পালিত হত। শ্যামবাজারের মধ্যেকার শিবমন্দিরের পুজো খুব বিখ্যাত ছিল। শিবরাত্রি উপলক্ষে তিন চারদিন ধরে যাত্রাপালা হত। তার মধ্যে প্রাধ্যা পেত উড়ে যাত্রা। শ্যামবাজার বাগবাজার অঞ্চলে বহু ওড়িশাবাসী মানুষের বাস করত। মূলত তাদের উৎসাহেই এই উড়ে যাত্রা হত। কথাও আবার যাত্রাভিনয়ের সঙ্গে পুতুল নাচও হত। পুরনো কলকাতার সেইসব অনুষঙ্গগুলি এখন আর হয় না।
আধুনিক কালচারের সঙ্গে সঙ্গে সেসব বিদায় নিয়েছে। শিবরাত্রির ব্রত পালনে নিষ্ঠার চেয়েও হুজুগটাই বেশি হয়ে উঠেছে। তবু এখনও এই শিবরাত্রির দিনে শহরের আনাচে কানাচে থাকা শিবমন্দিরগুলি সেজে ওঠে। সেখানে মন্ত্রোচ্চারণ, ব্রতকথা, নিশিজাগরণ যা-ই হোক না কেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বোধ হয় সত্যম শিবম সুন্দরম-এর উপাসনা।